দক্ষিণ এশিয়ার আধুনিক রাজনৈতিক দলের অফিস আওয়ামী লীগ কার্যালয়

142

নিজস্ব প্রতিবেদক: প্রতিষ্ঠার পর প্রথমবারের মতো নিজস্ব ভবন পেতে যাচ্ছে স্বাধীনতা-সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। দৃষ্টিনন্দন ও আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন বঙ্গবন্ধু এভিনিউ’র নতুন ১০ তলা ভবন হবে দক্ষিণ এশিয়ার আধুনিক রাজনৈতিক দলের অফিস ও আওয়ামী লীগের স্থায়ী ঠিকানা। আগামী ৬৯ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর দিন, ২৩ জুন, শনিবার আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন ভবনের উদ্বোধন করবেন।

নেতারা জানিয়েছেন, নতুন ভবন উদ্বোধনের পর আওয়ামী লীগের সব সাংগঠনিক কার্যক্রম চলবে ২৩, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ’র এ কার্যালয় থেকে। আর ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয় থেকে দলের নির্বাচনী কার্যক্রম ও সিআরআই সহ দলের অন্যান্য সংস্থার গবেষণামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে।

বুধবার (২০ জুন) দুপুরে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের নতুন দশতলা ভবনের কাজ শেষ। শনিবার (২৩ জুন) প্রধানমন্ত্রী এ ভবনের উদ্বোধন করবেন। পুলিশ সহ নিরাপত্তারক্ষীদের কড়াকড়ি ভবনজুড়ে। ঢুকেই হাতের বাম পাশে অভ্যর্থনা ডেস্ক। বিশাল ফ্লোর। সিঁড়ির পাশাপাশি দুটি লিফট। বেসমেন্ট ও প্রথমতলায় গাড়ি পার্কিংয়ের কথা বলা হলেও পরে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে আওয়ামী লীগ। সামনের সড়কে ছেড়ে দেওয়া নিজস্ব জায়গায় পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে।

নিচে রক্ষিত নির্দেশনা অনুযায়ী জানা যায়, চতুর্থ ও পঞ্চমতলায় সাধারণ অফিস, ডিজিটাল লাইব্রেরি, মিডিয়া রুম। ষষ্ঠ তলায় সম্মেলন কক্ষ। সপ্তম তলা দলের কোষাধ্যক্ষের জন্য। অষ্টম তলায় সাধারণ সম্পাদকের অফিস। আর নবম তলায় বসবেন দলের সভাপতি। একদম উপরে দশমতলায় থাকবে ক্যাফিটেরিয়া।

কর্তব্যরতদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নির্দেশনার কিছু ব্যত্যয় ঘটতে পারে। আগের নির্দেশনা অনুযায়ী বেসমেন্ট ও নিচ তলায় কার পার্কিং এবং ছাদে হ্যালিপ্যাড স্থাপন আপাতত হচ্ছে না। দ্বিতীয় তলার কনফারেন্স রুমে ৩৫০ জনের বসার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তৃতীয় তলায় ২৪০ জনের বসার ব্যবস্থা থাকবে। মাঝখানে কনফারেন্স রুম আর দুই পাশে বেশকিছু কক্ষ রয়েছে। তিন তলার সামনের অংশটা ‘ওপেন স্কাই টেরাস’। অনেকটা বাসার ড্রয়িংরুম বা পাঁচতারকা হোটেলের আদলে করা হবে এ অংশ। এখানে কৃত্রিম বাগানের ফাঁকে ফাঁকে চেয়ার-টেবিল দিয়ে বসার ব্যবস্থা থাকছে। পাশাপাশি থাকবে চা-কফি খাওয়ার আয়োজন।

এছাড়া ভবনের চার ও পাঁচতলায় দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ছাড়াও সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিমসহ সমমনা অন্যান্য সংগঠনের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হবে। সাত, আট ও নয়তলায় দলীয় সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক, বিষয়ভিত্তিক সম্পাদকসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের কক্ষ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে সভাপতির ফ্লোর থাকবে বুলেটপ্রুফ ডাবল গ্লাস। এছাড়া ভবনের বিভিন্ন তলায় রাখা হয়েছে ডিজিটাল লাইব্রেরি, সেমিনার রুম এবং সাংবাদিক লাউঞ্জ।

দলীয় সূত্র জানায়, আগামী ২৩ জুন, শনিবার আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও গণপূর্তমন্ত্রী ওই দিন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে নতুন কার্যালয়ের চাবি তুলে দেবেন। প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন শেষে সভাপতিমণ্ডলী, যুগ্ম সম্পাদকসহ অন্য নেতা ও সহযোগী সংগঠনগুলোর জায়গা নির্ধারণ করে দেবেন।

দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের জন্য রাখা হয়েছে সু-পরিসর কক্ষ। দলের সভাপতির কক্ষের সঙ্গে রয়েছে বিশ্রামাঘার ও নামাজের জায়গা। এছাড়া ডিজিটাল লাইব্রেরি, ভিআইপি লাউঞ্জ, সাংবাদিক লাউঞ্জ, ডরমিটরি ও ক্যান্টিন থাকছে। জানা গেছে, ভবনটির ছয় বা সাততলা পর্যন্ত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, কৃষকলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলালীগসহ বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের অফিস থাকবে।

আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন, টানা দুই মেয়াদ ক্ষমতায় থেকে বিপুল উন্নয়ন সাধন করায় আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা অনেকটাই বেড়েছে। পাশাপাশি গত দুই তিন বছরে সংগঠনও অনেকটা শক্তিশালী হয়েছে। সারাদেশে বেড়েছে কর্মী-সমর্থক। এসব কথা মাথা রেখেই আওয়ামী লীগের নতুন কার্যালয়টি নির্মিত হয়েছে বৃহৎ পরিসরে। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে নতুন কার্যালয়টি যেখানে নির্মিত হয়েছে, সেই জমিটি ইতোমধ্যে ৯৯ বছরের জন্য লিজ নেওয়া হয়েছে সরকারের কাছ থেকে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এজন্য বিদ্যুৎসহ নানা বকেয়া বিল মিলিয়ে সরকারকে দিতে হয়েছে ১ কোটি টাকা। ৮ কাঠা জায়গায় নির্মিত ভবনটি মাটির নিচে (গ্রাউন্ড ফ্লোর) একতলাসহ দশতলা ভবনের কাজ শেষ হয়েছে ইতোমধ্যে। আধুনিক প্রযুক্তিতে নির্মিত ভবনটি পুরোটাই থাকবে ওয়াইফাইয়ের আওতায়।

রোজ গার্ডেন থেকে ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ: গুটি কয়েক সদস্য নিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন উপমহাদেশের প্রাচীন দল আওয়ামী লীগ যাত্রা শুরু করেছিল রোজ গার্ডেনে। কালের বিবর্তনে সেই আওয়ামী লীগ আজ দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল। আন্দোলন-সংগ্রাম-ঐতিহ্যে দলটি পৌঁছেছে ইতিহাসের অনন্য এক উচ্চতায়। সময়ের ব্যবধানে প্রয়োজনের তাগিদে দলটিকে কার্যালয় পরিবর্তন করতে হয়েছে বেশ কয়েকবার।

রোজ গার্ডেন থেকে ১৯৫৩ সালে ৯ কানকুন লেনে, ১৯৫৬ সালে পুরান ঢাকায় ৫৬ সিমসন রোডে, ১৯৬৪ সালে ৯১ নবাবপুর রোডে, এরপরে সদরঘাটের রূপমহল সিনেমা হলের গলিতে, পুরানা পল্টনে কার্যালয় স্থানান্তরিত হয়ে দলটির সাংগঠনিক কার্যক্রম চলেছিল অনেকদিন। এরপর যায় সার্কিট হাউস রোডে।

১৯৮১ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দলের হাল ধরলে নানা বিবেচনায় আওয়ামী লীগের ঠিকানা হয় ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। সেটাও আজ থেকে প্রায় ৩৭ বছর আগে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, গণমুখী রাজনীতি, সংসদীয় নির্বাচন, দলটির ক্ষমতায় যাওয়া, সারাদেশে নেতাকর্মীদের সুসংগঠিত করাসহ সব পরিচালিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের এ কার্যালয় থেকেই।

শেখ হাসিনা তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে রাজনৈতিক আন্দোলন পরিচালনা করেই। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে দলটির পরিসর বেড়েছে অনেক। সারাদেশে অসংখ্য নেতাকর্মী ও সমর্থকের পাশাপাশি অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের কার্যক্রম এ ছোট্ট কার্যালয় থেকে পরিচালনা করা কঠিন হয়ে উঠেছিল শেষ কিছুদিন। সেই চিন্তা থেকেই ২০১১ সালে নতুন কার্যালয়ের পরিকল্পনা মাথায় আসে আওয়ামী লীগের।

সরকারি বিধি অনুযায়ী নানা কার্যক্রমের পর ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ভবন নির্মাণের আনুষ্ঠানিক কাজে হাত দেওয়া হয়। লক্ষ্য ছিল দুই বছরের মধ্যে কাজ শেষ করার। সেই হিসেবে আগামী সেপ্টেম্বরে ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার চার মাস আগেই শেষ হলো ভবন নির্মাণের। ভবন নির্মাণের নতুন কার্যালয় হিসেবে ব্যবহারের জন্য ভবন নির্মাণ করতে কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়নি। পূর্তমন্ত্রীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে ভবনটি নির্মিত হয়।

বিল্ডিং কোড মেনে সামনের দিকে রাস্তা থেকে ১০ ফুট ও পেছনের দিকে ১৭ ফুট জায়গা ছেড়ে মোট জমির ৬৫ শতাংশ ব্যবহার করে এটি তৈরি করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় নেতা ও ভবন নির্মাণ-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দলের নিজস্ব ফান্ড থেকে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ভবনটি নির্মাণ করা হয়। এর সামনের দেয়ালের দুইপাশ কাচ দিয়ে ঘেরা আর মাঝখানে সিরামিকের ইটের বন্ধন। সামনের দেয়ালজুড়ে দলের সাইনবোর্ডসহ দলীয় স্লোগান ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’, চার মূলনীতি খোদাই করে লেখা। ভবনের সামনে-পেছনে ছেড়ে দেওয়া জায়গায় হবে বাগান। এ ভবনের সামনে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহতদের স্মরণে স্থায়ী স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। ভবনটির প্রথম থেকে তৃতীয়তলা পর্যন্ত প্রতিটি ফ্লোর ৪ হাজার ১০০ বর্গফুট। চতুর্থতলা থেকে উপরের সব ক’টি ৩ হাজার ১০০ বর্গফুটের।

দলটির নেতারা মনে করছেন, নতুন দৃষ্টিনন্দন ও অত্যাধুনিক ভবনে আগামী জাতীয় নির্বাচনের কাজ পরিচালনা করতে গিয়ে উৎসাহ পাবেন দলটির নেতাকর্মীরা। ভবন নির্মাণের দায়িত্বে থাকা গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, নির্বাচনের আগে দলের নেতাকর্মীদের জন্য নতুন কার্যালয় একটি উপহার। নতুন করেই শুরু হবে পথচলা। আশা করছি নতুন ভবন আমাদের জন্য নতুন বিজয় বয়ে আনবে। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে আওয়ামী লীগের নতুন ভবন উদ্বোধন দলের নেতাকর্মীদের বাড়তি অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। আওয়ামী লীগের নিজস্ব ফান্ড থেকে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ভবনটির নির্মাণকাজ শুরু করা হলেও নির্মাণসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় নির্মাণ খরচ বেশ বেড়েছে।