মো. জাবের হোসেন : সুন্দরবন বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রশস্ত বনভূমি যা বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলীর অন্যতম। গঙ্গা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীত্রয়ের অববাহিকার বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত এই অপরূপ বনভূমি।বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট
জেলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দুই জেলা উত্তর চব্বিশ পরগনা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবন।
সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখণ্ড বনভূমি। দশ হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশে এবং বাকি অংশ রয়েছে ভারতের মধ্যে।
সুন্দরবনকে ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। এর বাংলাদেশ ও ভারতীয় অংশ বস্তুত একই নিরবচ্ছিন্ন ভূমিখণ্ডের সন্নিহিত অংশ হলেও ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় ভিন্ন ভিন্ন নামে সূচিবদ্ধ হয়েছে; যথাক্রমে “সুন্দরবন” ও “সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান” নামে।
সুন্দরবনকে জালের মত জড়িয়ে রয়েছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, কাদা চর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততাসহ ক্ষুদ্রায়তন দ্বীপমালা। মোট বনভূমির ৩১.১ শতাংশ, অর্থাৎ ১,৮৭৪ বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে নদী-নালা, খাঁড়ি, বিল মিলিয়ে জলাকীর্ণ অঞ্চল।
বনভূমিটি স্বনামে বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও নানান ধরণের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত।
জরিপ মোতাবেক ১০৬ বাঘ ও এক লক্ষ থেকে দেড় লক্ষ চিত্রা হরিণ রয়েছে এখন সুন্দরবন এলাকায়। ১৯৯২ সালের ২১শে মে সুন্দরবন রামসার স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সুন্দরবনে প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক ঘুরতে যায়। দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দার্যে মুগ্ধ। সুন্দরবন ভ্রমণ করার মাধ্যমে পর্যটকরা তার প্রকৃতি থেকে বিভিন্ন জ্ঞান অর্জন করে।
বাংলায় সুন্দরবন-এর আক্ষরিক অর্থ সুন্দর জঙ্গল বা সুন্দর বনভূমি। সুন্দরী গাছ থেকে সুন্দরবনের নামকরণ হয়ে থাকতে পারে, যা সেখানে প্রচুর জন্মায়। অন্যান্য সম্ভাব্য ব্যাখ্যা এরকম হতে পারে যে, এর নামকরণ হয়তো হয়েছে “সমুদ্র বন” বা “চন্দ্র-বান্ধে (বাঁধে)” (প্রাচীন আদিবাসী) থেকে। তবে সাধারণভাবে ধরে নেয়া হয় যে সুন্দরী গাছ থেকেই সুন্দরবনের নামকরণ হয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলার যে অংশে সুন্দরবন পড়েছে সেটি শ্যামনগর উপজেলায় অবস্থিত। পর্যটকদের জন্য এটি এ জেলার প্রধান আকর্যণ। সাতক্ষীরা শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে মুন্সিগঞ্জে অবস্থিত সুন্দরবন। এই মুন্সিগঞ্জ থেকে নদী পথে সুন্দরবনে যাওয়া যায়। সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসনের একটি স্লোগান রয়েছে, ” সাতক্ষীরার আকর্ষণ,সড়কপথে সুন্দরবন”।
একদিকে হিংস্র রয়েল বেঙ্গল টাইগার, কুমির, বানর, হরিণসহ বিভিন্ন পশুপাখিদের সমাহার, অন্যদিকে বনের গভীর নিরবতা খুব সহজেই পর্যটকদের আকর্ষণ করবে জায়গাটি। এ বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সব অংশে জনবসতি নেই। এর মধ্যে প্রায় এক তৃতীয়াংশ বনাঞ্চল। সুন্দরবনের মধ্যে যে পরিমাণ ভূমি তার পরিমাণ ১৪৪৫.১৮ বর্গ কিলোমিটার।
শ্যামনগর বাস স্ট্যান্ড থেকে মুন্সিগঞ্জ যাওয়ার জন্য সরাসরি বাস বা মটরসাইকেল পাওয়া যায়। এরপর বুড়িগোয়ালিনী যাওয়ার পর খেয়া ঘাট থেকে ট্রলার ভাড়া করে নিয়ে সরাসরি কলাগাছি যেতে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ মিনিটের মত সময় লাগে। যেখানে গেলে আপনি ট্রলার থেকে নামার পরেই দেখতে পাবেন শত শত বানর গাছে লাফা-লাফি করছে। তবে অাপনার হাতে যদি কোনো খাবার থাকে তাহলে বানরগুলো সরাসরি দৌঁড়ে চলে যাবে অাপনার কাছে। তবে অাপনার হাতে যদি কোনো লাঠি বা লম্বা ধরনের কিছু থাকে তাহলে অাপনার নিকটে যাবেনা বানরগুলো। ট্রলার থেকে কলাগাছি নামার পর বন বিভাগের নির্দিষ্ট জায়গা পর্যন্ত অাপনি হেঁটে হেঁটে কাঠের তৈরি রাস্তায় যেতে পারবেন।
সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্য, সবুজে আচ্ছন্ন গাছপালায় উড়ে বেড়াচ্ছে নানান জাতের পাখি। রৌদ্রোজ্জ্বল ঝকঝকে সকাল। হেমন্তের মাঝামাঝি সময়ে মৃদু শীতের আগমনী বার্তা। এমনি এক মনোরম পরিবেশে সকলের মনে এক ফুরফুরে ভালো লাগা অনুভূতি। ট্রলার চলছে বিরতিহীন। সবাই অধীর আগ্রহে ঘন জঙ্গলে ঘেরা নদীর পাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। হরিণের পাল দেখার জন্য। ভাগ্য ভালো থাকলে বাঘও দেখা যেতে পারে!কিন্তু হরিণ ছাড়া কিছু দেখা সম্ভব হয়নি।
সবথেকে মজার ব্যাপার হলো এই সুন্দরবনের ভিতরে ৫ তলা একটি সুউচ্চ টাওয়ার অাছে।যেখানে উঠলে অাপনি অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারবেন। তবে অাপনি যদি একেবারেই বনের ভিতরে যেতে চান সেক্ষেত্রে অাপনাকে কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে নিতে হবে।
কিছু দিন আগে বুলবুল ঝড় আঘাত হেনে ক্ষতি করে গিয়েছে আমাদের। আমার মনে হয় সুন্দরবন বাঁচালে আমরা বাঁচাবো, সুন্দরবন না বাঁচলে আমরা অস্তিত্বের হুমকিতে পড়ে যাবো।অ্যামাজনকে বলা হয় পৃথিবীর ফুসফুস। আমরা বলি সুন্দরবন আমাদের ফুসফুস। বলা হয় সুন্দরবন বাংলাদেশের নিরাপত্তা বলয়। তবুও সুন্দরবনকে আলাদাভাবে কোনো গুরুত্ব দেয়া হয় না, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক।
সুন্দরবন কেন্দ্রিক বাণিজ্যে যতটা লাভ হবে তার চেয়ে বহুগুণে ক্ষতি হবে। ধরুণ যদি সুন্দরবন না থাকতো তাহলে নার্গিস, সিডোর,আয়লা, বুলবুলের প্রভাবে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হয়েছে তার কত গুণ বেশি ক্ষতি হতো? সেটি কিন্তু সবার জানা কথা।
তাই দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা না নিলে পরে দাঁত দিয়ে আর খাওয়া যাবেনা।
ঢাকা শহরের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত উঁচু উঁচু দালানে বসে যারা সুন্দরবনের মৃত্যুসনদে সাক্ষর করেন, তাদের হয়তো কিছু হবে না। কিন্তু প্রকৃতির ভয়ংকর প্রতিশোধের শিকার হবে দেশের দক্ষিণাঞ্চল বিশেষ করে সাতক্ষীরা অঞ্চল।
আমার মনে হয় সুন্দরবন রক্ষা করার জন্য সরকারি ভাবে আলাদা তহবিল গঠন করা প্রয়োজন। বার বার বিপদে সুন্দরবন আমাদের ঢাল হয়ে দাড়াচ্ছে। সুন্দরবন ভালো থাকলে তা আমাদের দীর্ঘস্থায়ী নিরাপত্তা দিবে যা হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে নির্মাণ করা বাঁধও দিতে পারবে না। তাই আসুন সবাই মিলে সুন্দরবনকে রক্ষা করি সুন্দরবন আমাদেরকে রক্ষা করবে। সুন্দরবন ভালো থাকলে আমরা ভালো থাকবো। লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, লাল সবুজের কথা