মোঃ জাবের হোসেন : সাদা মাছের রেণু পোনা চাষ করে সাবলম্বী হয়েছেন বিভাষ। রোগবালাই কম থাকায় এবং খরচও কম হওয়ায় তিনি অতিদ্রুত অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হয়েছেন। ডাকনাম বাপ্পী পুরো নাম বিভাষ প্রতাপ সমাদ্দার।বাড়ি আশাশুনি উপজেলা আশাশুনি সদর ইউনিয়নের কুড়িকাহনিয়া গ্রামে। ২৯ বছর বয়সী এক তরুণ। বাবা মারা গেছে প্রায় দুই বছর আগে।সংসারে এক ভাই এক বোন। বোনের বিয়ে হয়েছে অনেক আগেই। আর মা সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা।চাকরির সুবাদে মা শ্যামনগরে থাকেন।প্রভাষ বাড়িতে একা থাকেন।
বিভাষ এসএসসি পাস করেছেন চাম্পাফুল মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ২০১৫ সালে। এইচএসসি পাশ করেছেন যশোর সিটি কলেজ থেকে ২০০৭ সালে। আর বিবিএ পাশ করেছে নর্দান ইউনিভার্সিটি মিরপুর শাখা থেকে ২০১২ সালে। এরপর এমবিএ করার জন্য জার্মান গিয়েছিলেন ২০১৪ সালে। কিন্তু বাবা অসুস্থ্য হয়ে যাওয়ার কারণে ২০১৫ সালের শেষের দিকে দেশে ফিরে আসেন জার্মান থেকে।সেসময় বাবা অসুস্থ্য থাকার কারণে বিভিন্ন জায়গায় ছুঁটা-ছুটির কারণে আর জার্মান যাওয়া হয়নি। কিন্তু বাবা ২০১৬ সালের শেষের দিকে মৃত্যুবরণ করেন।
এ সময় তিনি বলেন বাবা মারা যাওয়ার পরে তখন কি করবো সেটা বুঝতে পারছিলাম না। কারণ একা ভাই হওয়ায় কি করবো সেটা মাথায় ছিলোনা। এরপর ২০১৭ সালের প্রথম দিকে কলারোয়া থানার মাছ ব্যবসায়ী আজিজুল ইসলাম এর সাথে পরিচয় হয়। তার থেকে বিভিন্ন সময় পরামর্শ নিতে থাকি। সে আমাকে পরামর্শ দেয় তিনি যে কাজ করেন (মাছের হ্যাচারি) সেটা আমি করবো কিনা।বলেন তুমি যদি কাজ করতে চাও তাহলে আমার হ্যাচারিতে (কলারোয়া) একদিন আসো।
তার কিছুদিন পর চিন্তা ভাবনা করে দেখলাম নিজের বেশ কিছু জায়গা-জমি আছে সেগুলো যদি লিজ ছাড়িয়ে নিয়ে এই হ্যাচারির ব্যবসা করি তাহলে হয়তো ভালো কিছু আশা করা যায়। তারপর দুই পলি (ব্যাগ) সাদা কার্প জাতীয় মাছের রেনু পোনা নিয়ে আসি এবং তার পরামর্শ মত চাষাবাদ করতে শুরু করি। এতে করে প্রথম বছর ভালো লাভ হয়।
এরপর আশাশুনি উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা এসএম সেলিম সুলতানের পরামর্শ অনুযায়ী মাছ চাষ শুরু করি। সরকারি হ্যাচারি ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর থেকে মাছের ২ কেজি রেনু নিয়ে আসি।সেবার আমার খরচ বাদে ৫০ হাজার টাকা লাভ থাকে। ২০১৮ সালের শেষের দিকে বাড়ির পাশে একটি পুকুর লিজ নেই। তাতেও চাষাবাদ করে লাভবান হই।
তারপর থেকে আর পেঁছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর নিজের প্রায় তিন বিঘা জমিতে এক সাথে ধান-মাছ চাষ শুরু করি যেটাকে সমন্বিত মাছ চাষ বলে। ছোট মাছগুলো ০-১৫ দিন পর্যন্ত রাখা হয়। তারপর অন্যত্র সরানো হয়। ১৬-৪৫ দিন দ্বিতীয় জায়গায় রাখা হয় এবং বিক্রয় যোগ্য হয়। এরপর কিছু মাছ বিক্রি করি এবং সর্বশেষ নিজেই বড় করি সেগুলো।
রেণু পোনা ছেড়ে দেওয়ার সময় ওরস্যালাইন দিয়ে পরিমাণ মতো সবল করে নেই রেনুগুলোকে। ১০ লিটার পানিতে একটি ওরস্যালাইন দিলেই যথেষ্ট ।
তিনি বলেন, আমার সাফল্যে এখন এলাকার যুবকেরাও এই চাষে ঝুঁকছেন। তারাও স্বাবলম্বী হচ্ছেন। বিভাষ জানান তিনি শুরু হয়েছিল মাত্র ১৩ হাজার টাকা নিয়ে। বর্তমানে আছে ১৩ লক্ষ টাকা। বর্তমানে পুকুর-ঘেরসহ মাছ আছে ৭ লক্ষ টাকার মতো। কর্মচারী আছে তিনজন।
মৎস্য চাষীদের নিয়ে এলাকায় উঠান বৈঠক করেন। চাষীদের নিয়ে একটা সংগঠনও করেছেন।যার নাম “ধান্যহাটি কৃষি ও মৎস্য চাষী সংগঠন”। যার ২০১৮ সালে নিবন্ধিত করা হয়।তিনি বলেন আমরা প্রথম ত্রিশ জন সদস্য নিয়ে যাত্রা শুরু করি। যার বর্তমানে তিন শত সদস্য রয়েছেন। এখানে সদস্যরা ট্রেনিং নিয়েও লাভবান হচ্ছেন রেনু পোনা চাষ করে।এই সংগঠনের বর্তমানে অর্থ আছে প্রায় দশ লক্ষ টাকার মতো।
বিভাষ জানান, সকল খরচ বাদ দিয়ে তার বার্ষিক ৫-৬ লক্ষ টাকা লাভ থাকে।তারা আবার তাদের সংগঠনের লভ্যাংশ থেকে কিছু অংশ শিক্ষার্থীদের মেধা বৃত্তি দেয়। গ্রামের অসহায়দের নগদ অর্থও দিয়ে থাকে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় বিভাষ পুকুরের ওপরে মাঁচা করে দেশি মুরগি- হাঁস চাষ করছেন।তিনি আরো বলেন ছাগলের খামার করার জন্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আছে। আমাদের দেশে সাদা মাছ (মাগুর,বোয়াল) গুলোকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য চাষাবাদে কাজ করছি। উন্নত পদ্ধতিতে মৎস্য চাষ করতে চাই।আরো দেখা যায় পুকুরের পাড়ে সবজি চাষ করেছেন। সেখান থেকে সাংসারিক প্রয়োজন মিটিয়েও বছরে প্রায় ৫০-৬০ হাজার টাকা বাজারজাতকরণ করা হয়।
পুকুরের পাড়ে যেগুলো চাষ করা হয়েছে তন্মধ্যে আছে শসা, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, ধুন্দল, কুশি, চাল কুমড়া, পুঁইশাক ইত্যাদি। যেগুলো সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে কোন ঔষধ ছাড়াই ভার্মি দিয়ে চাষাবাদ করে থাকি।
তিনি জানান ১ কেজি কার্প জাতীয় রেনু পোনার দাম গড়ে ৩ হাজার টাকা। ১ কেজি রেনু পোনায় প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ মাছ হয়। প্রথম নার্সিং এর জন্য এক কেজি মাছের ১৭ শতক জায়গা লাগে। যেখানে ০-১৫ দিন পর্যন্ত নার্সিং করা হয়। দ্বিতীয় নার্সিং পয়েন্ট ১৬-৪৫ দিন পর্যন্ত নার্সিং করা হয়। প্রায় ৯৯ শতাংশ জায়গার প্রয়োজন হয়। ৪৫ দিন পর্যন্ত মাছ চাষ করলে প্রায় ২০০-২৫০ গ্রাম একটি মাছের ওজন হয়। এরপর ব্যবসায়ীদের কাছে মাছ বিক্রি করি। সেখান থেকে কিছু নিজের চাষের জন্য রেখে দেই। পরে ৪৬ থেকে ৯০/১০০ দিন পূর্ণাঙ্গ মাছে পরিণত হয় খাওয়ার জন্য।
প্রথম (১৬-৪৫ দিন) রেণু পোনার খাদ্য হিসাবে বাজারে বিভিন্ন ধরনের কিনতে খাদ্য পাওয়া যায়। ১০০ গ্রাম করে প্রত্যেকদিন দিতে হয়। যেটির হার প্রত্যেকদিন ৫০ গ্রাম করে বাড়াতে হয়। ১৬-৪৫ দিন জিও ফিড দেওয়া হয়। ১ কেজি মাছের জন্য প্রতিদিন ২০০ গ্রাম খাদ্য দিতে হবে। ৪৬-৯০ দিন একশ একশ হারে বাড়াতে হবে। এসব হাতে তৈরি করা খাবার দেয় হয়।খৈল, সয়াবিন, রাইস পাউডার, ইত্যাদি দিয়ে খাবার তৈরি করা হয়।
বিভাষ জানান, লাভ-ক্ষতির হিসাব মিলিয়ে খরচ ০-১৫ দিনের হিসাবে ৬ হাজার টাকার মতো। মাছ বিক্রি হয় ৫০-৬০ হাজার টাকা। ১৬-৪৫ দিনে খরচ ৭৫ হাজার টাকা। বিক্রয় হয় ১-১,৫ লক্ষ টাকা। ৪৬-৯০ দিন মোট খরচ হয় ১-১,৫ লক্ষ টাকা। মোট বিক্রয় হয় ৪,৫-৫ লক্ষ টাকা। তিন মাস অন্তর অন্তর এই প্রক্রিয়া চলমান থাকে। রুই,কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প এর মধ্যে আবার কিছু চিংড়ি ছেড়ে দেয়া হয়।
তিনি বলেন,রেনু মাছের রোগবালাই বলতে লেজ পচে যায়।তবে এক্ষেত্রে আমরা যে হলুদ দিয়ে তরকারি রান্না করি।সেই হলুদ ব্যবহার করতে পারি। পানির সাথে গুলিয়ে পুকুরে ছিটিয়ে দেই। রোগের মধ্যে আরো আছে মাছের উকুন। এই রোগের ঔষধ বাজার থেকে ফাইভফিনন ব্যবহার করি। তবে যদি চিংড়ি থাকে তাহলে ব্যবহার করিনা।
বিভাষের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে গ্রামের অনেক যুবকেরা এখন রেণু পোনার চাষে তাদের সাবলম্বী হওয়ার আশা দেখছেন। বিভাষের সাদা মাছের রেণু পোনা চাষের বিষয়ে আশাশুনি উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা এসএম সেলিম সুলতান বলেন,ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে সরকারি মাছের যে হ্যাচারি আছে সেখানে গুণগত মান রেখেই উৎপাদিত হয়।সেখান থেকে রেনু পোনা নিয়ে বিভাষের রেনুপোনা চাষাবাদের বিষয়ে আমি পরামর্শ দেই অনেক আগে।তারপর থেকে বিভাষের আন্তরিক প্রচেষ্ঠায় সে এখন একজন সফল রেনুপোনা মাছের চাষী। উপজেলা মৎস্য অফিস থেকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ সহ পরামর্শ অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি।