মো. জাবের হোসেন : প্রকৃতির বিরুপ আচরণ মানবগোষ্ঠীর জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরুপ। তবে এর জন্য দায়ী মানুষই। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, বন্যা, দাবানাল প্রভৃতিসহ নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যন্ত সারা বিশ্ব।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমাগতভাবে। স্পেন, ইরান, তিউনিশিয়া, চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অত্যধিক তাপমাত্রায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। এরই মধ্যে দেখা দিচ্ছে দাবানল। বাংলাদেশের সকল জেলায় বর্ষাকালেও নেই বৃষ্টি, অসময়ে হচ্ছে বন্যা, শীতকালে নেই শীত।
গত বৃহস্পতিবার সারা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রের্কড হয়েছে সাতক্ষীরা আর যশোরে। যেটি পূর্বে কখনো হয়নি। ব্রিটেনের ইতিহাসে গত ১০০ বছরের সব রের্কড ভেঙ্গেছে তাপমাত্রা। এগুলো আসলে কি সংকেত দিচ্ছে সেটি সবারই জানা। তবে আমরা বা সারা বিশ্ব যতটা সামরিক শক্তি, ভবিষ্যৎ সঞ্চয়ের জন্য চেষ্টা করি তার বিন্দু পরিমাণে কিন্তু পরিবেশ বা জলবায়ু নিয়ে চিন্তিত না। অথচ এই পরিবেশ বা জলবায়ুগত সমস্যার কারনে আমরা সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবো। যেটার কিছুটা এ বছর বুঝতে পারছি। হাজার হাজার কোটি টাকা উন্নত দেশগুলো তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে ব্যায় করছে, উন্নয়নশীল দেশগুলো মেগা প্রকল্পে লক্ষ-কোটি টাকা ব্যায় করছে অথচ সে পরিমাণে জলবায়ু নিয়ে চিন্তিত নয়।
উন্নত দেশগুলো জলবায়ু জনিত সমস্যার জন্য বেশি দায়ি। যার প্রভাব আমাদের মত দেশগুলোতেও পড়েছে। সম্প্রতি চিন কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটাচ্ছে। এগুলো প্রকৃতির উপর জুলুম ছাড়া কিছুই না। প্রকৃতি এগুলোর প্রতিশোধ ঠিকই নিবে বা নিচ্ছে।
ইউরোপীয় দেশগুলোতে আমাদের মত দেশগুলোর মানুষেরা যাওয়ার জন্য ব্যাকুল। কারন উন্নত দেশ, নাগরিক অনেক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। অথচ আবহাওয়ার কতটা বিপর্যয় সেখানে জানেন? ইউরোপের খরা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা European Drought Observatory in Europ (EDO) ২০২২ সালের আগস্টে Drought in Europe শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, বিগত ৫০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ খরার কবলে পড়েছে ইউরোপ। এ মহাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ অঞ্চলে রাষ্ট্রীয় জরুরি অবস্থা বা সতর্কতা জারি করা হয়েছে। শুধু তাই নয় এ মহাদেশের অভ্যন্তরীণ জাহাজ চলাচল, বিদ্যুত উৎপাদন এবং বেশকিছু ফসল উৎপাদন কমে গেছে। এ মহাদেশের ৪৭% অঞ্চল সতর্ক অবস্থার মধ্যে রয়েছে। এসব অঞ্চলের মাটির আদ্রতা দারুণভাবে কমে গেছে। যার প্রভাবে শাকসবজি উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
শিল্পবিপ্লবের আগে জলবায়ুর উপর এতটা প্রভাব পড়েনি। শিল্পবিপ্লবের পর থেকে নানা রকমের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কারণে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ধরা হয়েছিল শীর্ষবিন্দু। তবে সেই মাপকাঠি বেশ আগেই অতিক্রান্ত হয়েছে। এখন আশঙ্কা করা হয়েছে যে, অতি-যান্ত্রিকীকরণের কুপ্রভাবে এবং পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য বিনষ্টের কারণে চলতি একুশ শতকেই বৈশ্বিক তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা জানাচ্ছে এবছর বিশ্বের তাপমাত্রা রের্কড পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে।
নাসা বৈশ্বিক তাপমাত্রার অবস্থা জানাতে মানচিত্র প্রকাশ করেছে সম্প্রতি। নাসার মানচিত্রের লাল অংশে সবচেয়ে গরম আর নীল অংশে সবচেয়ে শীতল এলাকা নির্দেশ করছে নাসা। মানচিত্রে উত্তর আফ্রিকার পুরোটাজুড়েই তীব্র দাবদাহ চলছে। ইউরোপের দেশ স্পেনের শহর সেভিয়ায় তাপমাত্রা দেখাচ্ছে ৪২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরই মধ্যে স্পেনসহ পশ্চিম ইউরোপের দেশ পর্তুগাল ও ফ্রান্সে দাবদাহে সৃষ্ট দাবানল ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। ফ্রান্সের দাবানলে পুড়ে গেছে ৩৭ হাজার একরেরও বেশি এলাকা। পর্তুগালের লেইরিয়া শহরে ১৩ জুলাই তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছিল। দেশটিতে ৭ হাজার ৪০০ একর জমি দাবানলে পুড়ে গেছে। এদিকে ইতালিতে রেকর্ড তাপে ৩ জুলাই ডলোমাইটসের মারমোলাডা হিমবাহের একটি অংশ ধসের ফলে ১১ পর্বতারোহীর মৃত্যু হয়।
ইতালির প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘি বলেছিলেন, সন্দেহ নেই যে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত জলবায়ু পরিবর্তন।
জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক দিকে মোড় নিতে পারে। তাতে বিপর্যন্ত হবে মানবকূল প্রকৃতি সহ সবকিছু।
পরিবেশ, জলবায়ূ, প্রকৃতি নিয়ে সারা বিশ্ব সহ আমাদের দেশে কাজ করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুবই নগন্য অন্যান্যা প্রকল্পের তুলনায়। কিন্তু আমরা বা পরবর্তী প্রজন্ম যদি পৃথিবীতে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে চাই তাহলে আমাদের এখুনি উচিত জলবায়ূ, পরিবেশ, প্রকৃতি নিয়ে কাজ করা। সুন্দর এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার লক্ষ নিয়ে সবাই যতদিন না একসাথে কাজ করবে ততদিন ক্রমেই বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হবে এ বিশ্ব। বিপর্যন্ত হয়ে যাবে এ মানবকূল।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, লাল সবুজের কথা।