‘যার মনের মধ্যে আছে সাম্প্রদায়িকতা সে বন্যপশুতুল্য’। -শেখ মুজিবুর রহমান
১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের ২ এপ্রিল কলকাতায় হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয়েছিল, তা ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা, পাবনা প্রভৃতি জেলায়ও। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ তিনজন কবি-রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও জীবনানন্দ-এই দাঙ্গায় বিচলিত হয়েছিলেন এবং কবিতা লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘ধর্ম-মােহ’ নামে কবিতা এবং ধর্ম ও জড়তা নামে প্রবন্ধ। নজরুল লিখেছিলেন ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’, ‘যা শত্রু পরে পরে’ প্রভৃতি কবিতা এবং মন্দির-মসজিদ’, ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রভৃতি প্রবন্ধ। জীবনানন্দ লিখেছিলেন ‘হিন্দু-মুসলমান’ নামে কবিতা।
রবীন্দ্রনাথ সঠিকভাবে অনুধাবন করেছিলেন “ধর্মের জন্য যদি মানুষকে মারতে হয়, সে ধর্ম মিথ্যে। ধর্মের দোহাই দিয়ে যদি মানুষ মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে, এক শ্রেণীর অভিমানকে যদি আরেক শ্রেণীর উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, মানুষের অধিকারকে যা সঙ্কুচিত করে, তবে তা না মানাই শ্রেয়।” পৃথিবীতে ধর্মগুলো প্রবর্তিত হয়েছিল নিপীড়িত মানুষদের মুক্তি দিতে, যুগে যুগে নবী রাসূলের আগমন ঘটেছিল সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য কিন্তু কায়েমি স্বার্থবাদীরা তাদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ধর্মগুলোকে পরিণত করেছে স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়াররূপে। মানুষকে বন্দি করতে, ধর্মান্ধ করতে, পরমত অসহিষ্ণু করতে, সম্মোহিত ও বিভ্রান্ত করতে।
ভাষা, সংস্কৃতি ইতিহাস ও ঐতিহ্যে অমিল থাকার পরও শুধু ধর্মের দোহাই দিয়ে ১২০০ মাইল ব্যবধানের দুটি পৃথক ভূখণ্ডকে এক করে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়।পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় নিয়ে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালী।’ সদ্যঃস্বাধীন পাকিস্তানে ভাষার প্রশ্নে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল সে বিষয়ে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘প্রস্তাবিত পাকিস্তানের যদি একটি রাষ্ট্রভাষা হয় তবে গণতন্ত্রসম্মতভাবে শতকরা ৫৬ জনের ভাষা বাংলায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। একাধিক রাষ্ট্রভাষা হলে উর্দুর কথা বিবেচনা করা যেতে পারে’ (বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন, এম আবদুল আলীম, পৃষ্ঠা-৭৫)। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বক্তব্য আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল তখনকার প্রগতিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চিন্তার ধারক যুব সম্প্রদায়কে।
১৯৪৭ এর রাষ্ট্রীয় বিভাজন ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব যে উৎকট সাম্প্রদায়িকতার ফসল, ১৯৪৮ এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র কয়েক মাস যেতে না যেতেই, বাঙালি মূলে ফেলে দেয় ১৯৪৮ এর মার্চে রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে।
ভাষা আন্দোলনের ফলে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিকাশ ঘটে। পাকিস্তান সৃষ্টির সাম্প্রদায়িক ভিত্তি ভেঙে বাঙালিরা অসাম্প্রদায়িক চেতনার আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষীরা তাদের হারানো জাতিসত্তা খুঁজে পায়। তারা একক ও অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার পুনর্জাগরণ ঘটায়। যে সাম্প্রদায়িকতা পাকিস্তান সৃষ্টি করে, সেই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেই বাঙালি জনগোষ্ঠী রুখে দাঁড়ায় স্বল্পসময়ের ব্যবধানে। মুসলিম লীগ ও শাসকচক্র ধর্মকে ব্যবহার করে ভাষা আন্দোলনকারী ও সমর্থকদের ভারতের দালাল, অমুসলিম, কাফের বলে চিহ্নিত করেও আন্দোলন থামাতে পারিনি। বরং ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন পর হিন্দু – মুসলিম সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়।আওয়ামী মুসলিম লীগ মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নামকরণ করেন।১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ঘটনাবলিতে পাকিস্তান মুসলিম জাতীয়তাবাদের বিপরীতে একটি স্বতন্ত্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। একুশের শহীদেরা বুকের রক্ত দিয়ে এ দেশের উর্বর মাটিতে বপন করেছিল স্বাধীনতার বীজ। বাহান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতিসত্তার যে স্ফূরণ ঘটে, তা আর থেমে থাকে না সেই পথ ধরেই পৌঁছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত রণাঙ্গনে।ভাষা আন্দোলন-পরবর্র্তী সময়ে বাঙালিয়ানার যে জোয়ার আসে সেটাই আমাদের জাতীয়তাবোধের জন্ম দেয়।
একুশের পথ বেয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পর আমরা সুবর্ণ জয়ন্তীতে পৌঁছে গেছি।স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে এসে আমাদের ব্যর্থতাও কম নয়। একুশের চেতনায় একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল অসাম্প্রদায়িকতা। আমরা অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণে এখনও সফল হতে পারিনি। সাম্প্রদায়িকতা মানবতার চরম পরিপন্থি একটি সামাজিক প্রবণতা । পৃথিবীতে যুগে যুগে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প মানবতাকে কলুষিত করেছে । বর্তমান বিশ্বেও সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি মাঝে – মধ্যেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে । সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি পরিহার ছাড়া সুস্থ – সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ সমাজ কল্পনা করা যায় না । আমাদের উচিত সমাজ হতে সাম্প্রদায়িকতার বিষফোড়া উপড়ে ফেলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হওয়া ।
লেখক ঃ মামুন হাসান বিদ্যুৎ ,শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।