আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতীক মৃৎশিল্প

379
মৃৎশিল্প

রিপন হোসাইন,পাটকেলঘাটাঃ পাটকেলঘাটাসহ তালা উপজেলায় সর্বত্র অঞ্চলের সকল মানুষের কাছে ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতীক মৃৎশিল্প। সময়ের আবর্তনে পিষ্ট হয়ে সম্প্রতি হারিয়ে যেতে বসেছে এ শিল্প। তদাস্থলে আধুনিক সরঞ্জাম সহ প্লাস্টিক, স্টিল ও মেলামাইন সামগ্রীর ব্যবহার ব্যপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, শত শত বছর ধরে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আমাদের কুমোর সম্প্রদায় বংশ পরস্পরায় এ শিল্পকে আজও টিকিয়ে রেখেছেন। এক সময় সর্ব সাধারণের ভাত খাওয়ার জন্য প্লেট, রান্না করার হাঁড়ি ও গৃহস্থলির নানা কাজে ব্যবহার হত মৃৎশিল্প। এমন কি রাজা মহারাজারাও ব্যবহার করত এ শিল্প। বিভিন্ন ধরনের সৌখিন সামগ্রী হিসেবে তাদের গৃহে শোভা পেত মাটির তৈরি মনোমুগ্ধকর শিল্পকর্ম। এমনি করে সকলের কাছে এ শিল্পের যথেষ্ট কদর ছিল।

বর্তমানে প্লাস্টিক সামগ্রী সহজলভ্যতা ও ব্যবহার এতটাই সুবিধাজনক যে, মৃৎশিল্প ব্যবহার সবাই ছেড়ে দিচ্ছে। বর্তমানে প্লাস্টিক, সিরামিকের প্রতিযোগিতা পূর্ণ বাজারে মৃৎশিল্প হার মানতে বসেছে। এ শিল্পের কাঁচামাল অর্থাৎ দূর থেকে মাটি বহন, কাঁঠের ও কয়লা সহ সকল প্রকার কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি এবং পরিবহন খরচ সব কিছু বেশি হওয়ার কারণে কুমোররা তাদের পৈত্রিক পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে ক্রমশ। বহু বছর পূর্বে মাটির তৈরি থালা-বাসন, হাঁড়ি সহ নানাবিধ ব্যবহার করতঃ মানুষ প্রতিনিয়ত। কিন্তু সেখানে আজ হাতে গোনা কয়েকটি সৌখিন শিল্পকর্ম আমাদের গৃহে শোভা পাচ্ছে।

এমনি করে দেশের মৃৎশিল্প হারিয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। মাটি দিয়ে তৈরি জিনিসের চাহিদা কিছুটা আমাদের আজও রয়ে গেছে বাজারে। মাটির তৈরি পাত্র, হোটেলের দই, মিষ্টি সহ অন্যান্য খাবার রাখা এবং রাধুনিরা মালসা ও সরার ব্যবহার হিসেবে আজও প্রচলন আছে। পাশাপাশি মাটির তৈরি ঘট(পয়সা রাখার জন্য), ফুলের টব সহ মনোমুগ্ধকর শিল্প কর্ম এখনো বাজারে বিদ্যমান। কিন্তু যে পরিমান কুমোর সম্প্রদায় বংশপরস্পরায় এ শিল্পের সাথে আজও জড়িত, সে হিসেবে এর বাজার নেই বললেই চলে। সব কিছুর দাম সীমাহীন বাড়লেও দাম বাড়েনি মৃৎশিল্পের কোন সামগ্রীর। ১টি দই এর খুলি ৫-৭ টাকা। মালসা ও সরা ৭-১০ টাকা, ১টি কলস বিক্রি হচ্ছে ১৫-২০টাকা। যাহা বিক্রয় করে সামান্য লাভ থাকবে বলে জানালেন এ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা।

আজ ইহার প্রতি টান থাকলেও এ পেশা থেকে সরে যেতে বাধ্য হচ্ছে বলে তারা জানায়। জীবিকার প্রয়োজনে অনেকেই অন্য পেশা বেছে নিলেও অবসরটা তারা কাজে লাগাচ্ছে এ শিল্পের কর্মে। কারণ পুরুষরা অন্য পেশা বেছে নিলেও ঘরের বধুরা খুব সহজে মৃৎশিল্পের কাজ করতে পারে। যে কারণে আজও তারা টিকিয়ে রেখেছে মৃৎশিল্প। প্রতিনিয়ত মাটির জিনিসের চাহিদা কমে গেলেও চাহিদা আছে বিভিন্ন রং করা কারুকার্য খচিত সৌখিন সামগ্রীর। প্লাস্টিক, স্টিল এবং মেলামাইন সামগ্রীর ব্যবহার প্রতিনিয়ত বাড়তেই আছে। কারণ হিসেবে অনেকেই মনে করছেন সহজে বহন সুবিধা, পড়ে গেলে ভাঙ্গার ভয় নেই, দামও হাতের নাগালে। আবার ভাঙ্গা অংশ বা পুরানো জিনিস পুনঃরায় বিক্রয় করে একটি বিশেষ মূল্য পাওয়া যায়।

যার সাথে সামান্য কিছু অর্থ যোগান দিয়ে পুনঃরায় নিত্য ব্যবহার সামগ্রী ক্রয় করা সম্ভব হয়। তবে অনেকেই মনে করছেন, মাটির তৈরি জিনিস ব্যবহার অধিক স্বাস্থ্যকর। যেটা অন্য কোন দ্রব্য সামগ্রীর হতে পারে না। স্বাস্থ্যগত সমস্যা সমাধানে মাটির তৈরি জিনিসের ব্যবহার প্রভাব রাখতে পারে।তালা উপজেলার পাটকেলঘাটা থানা সদরে মৃৎশিল্পের কাজে নিয়োজিত কার্ত্তিক পালের স্ত্রী শষ্টি রানী পাল বলেন, কয়েক বছর পূর্বে এখানে ১২-১৫ঘর লোক সর্ব সময় মাটির তৈরি জিনিসের কাজে ব্যস্ত থাকতো। কিন্তু এখন ৪-৬ঘর লোক এ কাজে নিয়োজিত আছে। ইহার প্রতি মানুষের তেমন কোন চাহিদা নেই। শীত মৌসুমে খেঁজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য ভাঁড় এবং গৃহস্থলির কিছু কাজে মাটির তৈরী জিনিসের চাহিদা এখনো আছে। তালা উপজেলা প্রায় দু’শতাধিক মৃৎ শিল্প পরিবারের মাঝে দূর্দিন হওয়ায় অনেকেই এ পেশা ছেড়ে বাজারে ব্যবসা বাণিজ্যের কাজে নিয়োজিত হচ্ছে।

সার্বিক দিক বিবেচনা করে সকল মহলের ধারণা, সরকারি-বেসরকারি ভাবে সামান্য উদ্যোগ গ্রহণ করে পর্যাপ্ত মান নিয়ন্ত্রণ করে দেশে-বিদেশে বাজার সৃষ্টি করা, সকল মানুষের সচেতনতা ও আন্তরিকতা সৃষ্টি সহ প্লাস্টিক ও অন্যান্য সামগ্রীর ব্যবহার একটু কমিয়ে মাটির তৈরি জিনিস ব্যবহার করা হয় তাহলে আমাদের মৃৎশিল্প বেঁচে থাকবে অনন্তকাল।