সাড়ে চারশ বছরের প্রাচীন দর্শনীয় স্থান ঐতিহ্যবাহী ভালুকা চাঁদপুর জামে মসজিদ

386
সাড়ে চারশ বছরের প্রাচীন দর্শনীয় স্থান ঐতিহ্যবাহী ভালুকা চাঁদপুর জামে মসজিদ

এম এম নুর আলম: প্রায় সাড়ে চারশ বছর আগের প্রাচীন দর্শনীয় স্থান সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ধুলিহর ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী ভালুকা চাঁদপুর জামে মসজিদ। এ মসজিদটির মাটি ও পানি অনেকের কাছে মহৌষধ হিসাবে বিবেচিত। তথ্যানুসন্ধানে জানাগেছে, প্রায় সাড়ে চারশ বছর আগে ভালুকা চাঁদপুর গ্রামে মানিক চৌধুরী নামে এক সিদ্ধ পুরুষ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ভালুকা চাঁদপুর জমিদার বংশের সন্তান। জনশ্রুতি আছে, এই গ্রামে খালাস সরদার নামে এক দরিদ্র ব্যক্তি বাস করতেন। তিনি ছিলেন অতি পরহেজগার ও খোদাভক্ত। অলৌকিকভাবে তিনি বহু গুপ্ত সম্পদের অধিকারী হন।

এ সম্পদ দিয়ে তিনি নদীয়ার রাজা কৃষ্ণ চন্দ্রের নিকট থেকে তার ছেলে আজমত উল্যাহর নামে একটি জমিদারি পরগনা ক্রয় করেন। পরগনা কেনার সম্মানে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তার নাম দেন আজমত উল্যাহ চৌধুরী। পরগনা কেনার পর তা রক্ষার জন্য একশ বিঘা জমির চারপাশে একটি খাল খনন করেন। যা ‘গড়’ নামে পরিচিত। আকারে ছোট হওয়ায় একে গড়ের গাভীও বলা হয়। এই গড়ে ১৬ জন মাঝি নৌকায় করে দিনরাত পরগনা পাহারা দিত। কারণ সে সময় পাশের সুন্দরবনসহ বহিরাগত ডাকাতদের উপদ্রব ছিল। জমিদার আজমত উল্যাহ চৌধুরীর ছিল ৭ ছেলে। তার মধ্যে মানিক চৌধুরী ছিলেন একজন।

তিনি ছিলেন অলিয়ে কামেল এবং বিশিষ্ট দরবেশ। জনসাধারণের নামাজের সুবিধার্থে তিনি ভালুকা চাঁদপুর গ্রামে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট এ মসজিদ নির্মাণ করেন। ২৬ হাত দৈর্ঘ্য ও ১০ হাত প্রস্থ বিশিষ্ট এ মসজিদের দেয়াল ৪০ ইঞ্চি পুরু। মসজিদের পাশেই আড়াই বিঘা আয়তনের কবরস্থান। মসজিদের দক্ষিণপাশে বিশাল দিঘি রয়েছে। দিঘিটির আয়তন সাড়ে চার বিঘা। সাড়ে চারশ বছর পরও মানুষ এ দিঘির পানি মহৌষধ হিসেবে ব্যবহার করে। মসজিদের দিঘির পাড়ে হাবীবা সুলতানা নামের এক গৃহবধূর সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের কথা হলে এসময় তিনি জানান, বিয়ের আঠারো বছর পর সন্তানের মুখ দেখেছেন তিনি। সন্তানের মুখে প্রথম ভাত দিতে পাইকগাছা থেকে ভালুকা চাঁদপুরে অবস্থিত সাড়ে চারশ বছরের ঐতিহ্যবাহী জামে মসজিদে এসেছেন তিনি।

এ মসজিদে আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিঃসন্তান থাকা কালে তিনি সৃষ্টিকর্তার কাছে একটি মানত করেছিলেন। আর সেটি হল- যদি তার সন্তান হয় তবে ভালুকা চাঁদপুর জামে মসজিদে মানিক চৌধুরী (রহঃ) দরগায় একটি খাসি কোরবানি দিয়ে সন্তানের মুখে ভাত দেবেন। সৃষ্টিকর্তা তার ডাক শুনেছেন। সেই সন্তানের মুখে ভাত ও খাসি কোরবানি করতে সপরিবারে এসেছেন মানিক চৌধুরী (রহঃ) দরগায়। বছর দেড়েক আগেও একাধারে কয়েক শুক্রবার এখানে এসেছিলেন তিনি। একটি বিশেষ নিয়ম মেনে মসজিদের মাটি-পানিও ব্যবহার করতেন তিনি।

দেখা গেছে, মনের আশা যাতে পূরণ হয় সে কারণে এখানে প্রতি শুক্রবারে আসে শতশত পরিবার। এদের কেউ আসে নিঃসন্তান থেকে সন্তানের আশায়, কেউ আসে রোগমুক্তির আশায়, কেউ আসে নতুন ফসলের ভালো ফলনের আশায়। ভক্তদের আগমনে প্রতি শুক্রবার এখানে মেলা বসে। ভক্তদের কেউ আসেন মোরগ নিয়ে, কেউ আসেন ক্ষেতের প্রথম ফসলের অংশ নিয়ে, কেউ বাগানের ফল, কেউ ঘেরের প্রথম ধরা মাছ, কেউ গরু-ছাগল নিয়ে। এভাবে প্রতি শুক্রবার ভক্তদের মিলনমেলায় পরিণত হয় ভালুকা চাঁদপুরের ঐতিহ্যবাহী জামে মসজিদ প্রাঙ্গণ। সরেজমিনে দেখা যায়, ভক্তরা দিঘীর পানিতে গোসল শেষে বোতলে পানি ভরে রাখছে মসজিদের সামনে।

এরপর মসজিদের সামনের প্রাচীরের গোড়া থেকে মাটি নিয়ে রাখছে বোতলের পাশে। নামাজ শেষে সেই পানি-মাটি পরম ভক্তিতে ব্যবহার করছে তারা। এ দৃশ্য দু-এক বছরের নয়। এটি সাড়ে চারশ বছর ধরে চলছে। স্থানীয়রা জানান, প্রায় সাড়ে চারশ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদে প্রতিদিন শত শত মুসল্লি নামাজ আদায় করেন। শুক্রবার এখানে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানত আদায় ও মানত করতে দশ থেকে বারো হাজার মানুষ আসেন। বেশি আসেন নারী। মসজিদে পুরুষের পাশাপাশি পৃথকভাবে নারীদেরও নামাজ আদায় করার ব্যবস্থা আছে। এখানে এক সঙ্গে দুই হাজার পুরুষ ও পাঁচশত জন নারী এক জামাতে নামাজ আদায় করতে পারেন।