সাতক্ষীরায় পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনশুমারী প্রকল্পে নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগ

406

মোঃ খলিলুর রহমান : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনশুমারী ও গৃহগণনা ২০২১ প্রকল্পে সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় গণনাকারী ও সুপারভাইজার নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অর্থ লেনদেন ও নারী কেলেঙ্কারীর অভিযোগ উঠেছে।

এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের নাম ব্যবহার করে উপজেলা পরিসংখ্যান অফিসার আবু তালেব ৬ লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। বিষয়টি ফাঁস হয়ে যাওয়ায় তিনি এখন অফিস করছেন না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২১ প্রকল্পের অধীন খানা তালিকা প্রস্তুত করার জন্য ম্যানপাওয়ার প্যানেল তৈরির নির্দেশ দেয়। এজন্য উপজেলা পরিসংখ্যান অফিসার আবু তালেব গণনাকারী ও সুপারভাইজার নির্বাচনের উদ্যোগ নেন। গোপনে প্রশ্নপত্র তৈরী করে নিয়োগ পরীক্ষার আয়োজন করেন। দালালের মাধ্যমে আবেদনকারীদের সাথে যোগাযোগ করে টাকা সংগ্রহ করতে থাকেন। প্রতি প্রার্থীর কাছ থেকে ১ হাজার থেকে ২ হাজার করে টাকা নেন। বিনিময়ে মোবাইলের মাধ্যমে তাদের প্রশ্নপত্র সরবরাহ করেন। বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে ২৪ জানুয়ারী ২০২০ তারিখে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। ওয়েবসাইটে লেখা হয় ‘অনিবার্য কারণবশত ভাইভা পরীক্ষা স্থগিত করা হলো। আবেদন যাচাই-বাছাই শেষে তালিকা প্রকাশ করা হবে এবং লিখিত পরীক্ষার তারিখ পরবর্তীতে ওয়েবসাইটে জানিয়ে দেয়া হবে’। এই মর্মে বিজ্ঞপ্তি দেন।

২৭ জানুয়ারী ২০২০ তারিখে সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার দেবাশীষ চৌধুরীর স্বাক্ষরে নোটিশ দিয়ে জানানো হয়, গণনাকারী ও সুপারভাইজারদের নির্বাচনের লক্ষ্যে উপজেলা যাচাই বাছাই কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। ৩১ জানুয়ারী ২০২০ তারিখে সাতক্ষীরা পৌরসভার আবদনকারীদের পিএন মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং সকল ইউনিয়নের আদেনকারীদের নবারুণ বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় লিখিত পরীক্ষা হবে। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণকারীদের তালিকা করা হয়। ৫ ফেব্রুয়ারী ২০২০ তারিখে এই তালিকায় স্বাক্ষর করেন নিয়োগ কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী অফিসার দেবাশীষ চৌধুরী, সদস্য সচিব উপজেলা পরিসংখ্যান অফিসার আবু তালেব, উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা অফিসার নকিবুল হাসান, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার জাহিদুর রহমান, উপজেলা শিক্ষা অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) বাসুদেব কুমার সানা এবং মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের প্রোগ্রাম অফিসার ফতেমা জোহরা। কিন্তু অভিযোগ ওঠে উপজেলা পরিসংখ্যান অফিসার আবু তালেব যাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলেন তারা নাম লেখা সাদা খাতা জমা দেন এবং পরবর্তীতে পরিসংখ্যান অফিসারের লোকজন তা পূরণ করে নেন।

পরবর্তীতে ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২০ তারিখে ধুলিহর, ফিংড়ী, ঘোনা, ঝাউডাঙ্গা, বল্লী, বৈকারী ও লাবসা ইউনিয়ন, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২০ তারিখে আগরদাঁড়ী, আলিপুর, বাঁশদা, ভোমরা, ব্রক্ষ্মরাজপুর, কুশখালী ও শিবপুর ইউনিয়ন এবং ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২০ তারিখে সাতক্ষীরা পৌরসভার প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা হয়।

মৌখিক পরীক্ষায় ধুলিহর ইউনিয়নে ২ জন সুপার ভাইজার ও ১৬ জন গণনাকারী, ফিংড়ী ইউনিয়নে ৫ জন সুপার ভাইজার ও ১৯ জন গণনাকারী, ঘোনা ইউনিয়নে ২ জন সুপার ভাইজার ও ১০ জন গণনাকারী, ঝাউডাঙ্গা ইউনিয়নে ৩ জন সুপার ভাইজার ও ১৯ জন গণনাকারী, বল্লী ইউনিয়নে ২ জন সুপার ভাইজার ও ১০ জন গণনাকারী , বৈকারী ইউনিয়নে ২ জন সুপার ভাইজার ও ১১ জন গণনাকারী, লাবসা ইউনিয়নে ২ জন সুপার ভাইজার ও ১৬ জন গণনাকারী, আগরদাঁড়ী ইউনিয়নে ৩ জন সুপার ভাইজার ও ২২ জন গণনাকারী, আলিপুর ইউনিয়নে ৩ জন সুপার ভাইজার ও ১৯ জন গণনাকারী, বাঁশদা ইউনিয়নে ২ জন সুপার ভাইজার ও ১২ জন গণনাকারী, ভোমরা ইউনিয়নে ২ জন সুপার ভাইজার ও ১৪ জন গণনাকারী, ব্রক্ষ¥রাজপুর ইউনিয়নে ২ জন সুপার ভাইজার ও ১৩ জন গণনাকারী, কুশখালী ইউনিয়নে ২ জন সুপার ভাইজার ও ১৩ জন গণনাকারী, শিবপুর ইউনিয়নে ২ জন সুপার ভাইজার ও ১২ জন গণনাকারী এবং সাতক্ষীরা পৌরসভায় ১৩ জন সুপার ভাইজার ও ৬৬ জন গণনাকারী নিয়োগ দেন। সর্ব মোট ৪৭ জন সুপারভাইজার ও ২৭২ জন গণনাকারী চূড়ান্ত করা হয়। এদের কাছ থেকে আনুমানিক ৬ লাখ টাকা চা-নাস্তা খরচ নিয়েছেন। এই চূড়ান্ত তালিকায় স্বাক্ষর করেন নিয়োগ কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী অফিসার দেবাশীষ চৌধুরী, সদস্য সচিব উপজেলা পরিসংখ্যান অফিসার আবু তালেব, উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা অফিসার নকিবুল হাসান ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার জাহিদুর রহমান। দুর্নীতির কারণে বাকি দুজন স্বাক্ষর করেননি।

চূড়ান্ত তালিকায় দেখা গেছে, একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তি, স্বামী-স্ত্রী এবং সদর উপজেলা বহির্ভূত কালিগঞ্জ, কলারোয়াসহ অন্যান্য উপজেলার ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। ফিংড়ী ইউনয়নের তালিকায় ১ নম্বর সুপারভাইজার বিশ্বজিৎ কুমারের শ্যালক ৮ নম্বর জয়েশ বিশ্বাস এবং স্ত্রী নম্বর স্ত্রী জয়া বিশ্বাস। জয়েশের বাড়ি কালীগঞ্জ উপজেলায়। এদের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে তালিকায় নাম অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। বল্লী ইউনিয়নের তালিকায় ৪ নম্বর রাশেদ হোসেন ও ৫ নম্বর ফারজানা খাতুন ভাই-বোন, ১০ নম্বর মোসলেম আলী ও ১১ নম্বর এলিজা খাতুন ভাই-বোন, ভোমরা ইউনিয়নের তালিকায় ১ নম্বর সৌমেন কুমার ও ২ নম্বর শোভন ভাই-ভাই এবং ১১ নম্বর আশুরা খাতুন ও ১২ নম্বর মিজানুর রহমান ভাই-বোন। আবার মৌখিক পরীক্ষায় হাজির হয়নি এমন প্রার্থীও তালিকায় স্থান পেয়েছে। উপজেলা পরিসংখ্যান অফিসার আবু তালেব কলারোয়া পৌরসভার পাশে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। এখানে বেশ কিছু মহিলা প্রার্থীর আনাগোনা আছে বলে অভিযোগ রযেছে।

নিজের সাফাই গাইতে গিয়ে তিনি প্রচার করছেন এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের চাপে এসব অনিয়ম করতে হয়েছে। আমার কিছু করার ছিল না। এখন আমার পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে।