বিশ্ব ভালোবাসা দিবস

169
বিশ্ব ভালোবাসা দিবস valentines day

মাহবুবুজ্জামান সেতুঃ  আমাদের বাংলাদেশে ভাষার মাস হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব পায় ফেব্রুয়ারি। এই মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাংলা দিন পঞ্জিকার ফাগুন মাসের আরম্ভ। ঋতুচক্রের শেষ ঋতু বসন্তেরও শুরু ফেব্রুয়ারিতেই। এই মাসে আরও যোগ হয়েছে ভালোবাসা দিবস নামের একটি দিন। বিশ্ব সংস্কৃতির অনুসরণে, অনুকরণে। ২১ ফেব্রুয়ারির মাত্র এক সপ্তাহ আগে ১৪ তারিখে এই দিবসটি খুব ঘটা করে আমাদের দেশে পালন করা হয়।

এই দিনটি বর্তমানে আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডেও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ফুল বেচাকেনা হয় এই ভালোবাসা দিবসে কয়েক কোটি টাকার। ভালোবাসার প্রতীক ফুল। ভালোবাসা দিবসে প্রিয় মানুষকে ফুল উপহার দিয়ে ভালোলাগা, ভালোবাসা ও পছন্দের গোপন বা প্রকাশ্য অনুভূতি জানান দেওয়া হয়। প্রিয়জনকে ফুল দিয়ে ভালোবাসার কথা জানানোই সর্বোত্তম উপায়, এর চেয়ে উৎকৃষ্ট ব্যবস্থা আর হতে পারে না। তবে ইদানীং সমাজে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন কাপড় দেওয়ার রীতিও। নারী-পুরুষের পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে জুতা স্যান্ডেল, অলঙ্কার কেনার সংস্কৃতি। বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার বিস্তৃত হয়েছে ভালোবাসা দিবস কেন্দ্র করে গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত।

অন্যদিকে জাতীয় গৌরব চেতনার ভিত্তি ভাষা শহিদ দিবস কেন্দ্র করে প্রকাশনা বাণিজ্য বলা যায় শুধুমাত্র রাজধানী শহর ঢাকা-কেন্দ্রিকই এখনও। গণমাধ্যমেও এই দুই দিবস উপলক্ষে বিপুল আয়োজন থাকে। বসন্ত বরণ উপলক্ষেও প্রচুর ফুল, পোশাক এবং আনুষঙ্গিক উপাদানের বেচাকেনা চলে। আর যাই হোক আমাদের অর্থনীতির এক বিরাট অংশ জুড়ে আছে এই দিবসগুলোর আনুষ্ঠানিকতা।
ভালোবাসা দিবস আমাদের সংস্কৃতিতে আমদানিকৃত। কিন্তু বসন্ত এবং ভাষা শহিদ বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস একান্তই আমাদের নিজস্ব, আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। ভালোবাসা দিবসও এখন আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিতে জায়গা করে নিয়েছে।

ভালোবাসা দিবসের প্রাথমিক ইতিহাস যতটুকু জানা যায়, তা ছিল মূলত কৃষিব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত। মনে করা হয়, প্রাচীন রোমকদের কোনও উৎসব আচার হতে ভালোবাসা দিবসের উৎপত্তি। এই উৎসব মূলত ফনাস নামের এক প্রকৃতি দেবতা-কেন্দ্রিক ছিল। প্রাথমিক উদ্দেশ্য শস্যক্ষেত্র ও পালিত পশু ইত্যাদির উর্বরতা বৃদ্ধি কামনা, পাশাপাশি জনগোষ্ঠীরও। পরবর্তীকালে সন্ত ভ্যালেন্টাইন নামের দুজন রোমক শহিদের স্মারক বার্ষিক ভোজনোৎসবের তারিখ ১৪ ফেব্রুয়ারির সঙ্গে যুক্ত হয়র ব্যাপকভাবে পালিত হতে থাকে। এই সন্ত দুজন তৃতীয় শতাব্দীতে জীবিত ছিলেন বলে বলা হলেও একবারে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা সম্ভব হয়নি। আরেক রকমের বিবরণে সন্ত ভ্যালেন্টাইনকে প্রেমিক সন্ত বা তাদের পৃষ্ঠপোষকরূপে ঐতিহ্যগতভাবে সম্মান করা হয়। কারাগারে আবদ্ধ দুই প্রেমিক-প্রেমিকার মিলনে সন্ত ভ্যালেন্টাইন বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন বলেও কোনও কোনও সূত্রে উল্লেখ দেখা যায়।

দিনটি পালনে বিশেষ কিছু নিয়ম মেনে চলা হত আগে। তবে বর্তমানে সেই নিয়ম আর তেমন কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয় না। বরং বিষয়টি সর্বজনীন মর্যাদা পেয়েছে। ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখে পছন্দের পাত্রপাত্রীর নিকট উপহার সামগ্রী বা শুভেচ্ছাপত্র পাঠিয়ে দিনটি পালন করা হত। উপহারে ব্যবহৃত কার্ডটিই সাধারণত ভ্যালেন্টাইন নামে অভিহিত। কার্ডটি হৃদয় সংকেত বা ভালোবাসার প্রতীক চিত্র দিয়ে চিত্রিত বা অংকিত হয়। অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য পছন্দের পাত্রপাত্রীর নিকট প্রেরিত বার্তা বা উপহার ছদ্ম নামে পাঠানোর নিয়ম। প্রকৃত পরিচয় গোপন রাখা হলেও এখন আর তা অনুসরণ করা হয় না।

বিজ্ঞানের প্রসার ও চর্চার ফলে সমাজ মানসের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক আদান-প্রদান এখন অত্যন্ত সহজ এবং বাধা-বিধির বাইরে। আমাদের সমাজে ভালোবাসা দিবসের আমদানি দশক দুয়েক আগে। মনে করা হয়, একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সামনে রেখে এই দিবসটি সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়েছিল প্রাথমিক পর্যায়ে। শিক্ষা ব্যবস্থার নানারকম সংস্কারবাজির কারণে কয়েক প্রজন্ম নিজস্ব ঐতিহ্য সংস্কৃতি এবং জাতিগত অভ্যুদয়ের ইতিহাস সম্পর্কে ভুল বা খন্ডিত ধারণা লাভ করছিল। তেমন পরিবেশে যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে আত্মজিজ্ঞাসা বা আত্মপরিচয়ের কোনও আগ্রহ বা আকাংক্ষা ছিল না। ছিল না নিজ সংস্কৃতি চর্চার পৃষ্ঠপোষকতা। তাছাড়া আমরা ঔপনিবেশিক মানসিকতার শিক্ষায় সর্বদাই বিদেশ-বিজাতি-সংস্কৃতি তোষণে পোষণে, পালনে-লালনে এক পা নয় কয়েক পা এগিয়ে।

যেখানে ভাষা আন্দোলনের মাসে আমাদের যুব সমাজের স্বজাতির ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে ব্যাপক অধ্যয়ন, চর্চা ও অনুশীলনের কথা; তেমন পরিস্থিতিতে তাদেরকে সেই পথে উৎসাহিত না করে একটি বিজাতীয় সংস্কৃতির আমদানি করে জাতীয় যুবমানসকে যে ভিন্ন পথে চালনা করার অসৎ উদ্দেশ্য ছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ থাকার কোনও কারণ নেই। যারা ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে বা ইংরেজি জানা বা বলা আভিজাত্যের অংশ মনে করে তারা বিষয়টি লুফে নিতে দেরি করে না। তাদের দেখাদেখি যুব সমাজের অন্য অংশও তা অনুসরণে অতি উৎসাহী হয়। ফলস্বরূপ আজকের বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবসের জয়জয়কার। ঘটা করে পালিত হয়।

এখন আর শুধু যুব সম্প্রদায়, প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যেই দিনটি পালন সীমাবদ্ধ নয়। নারীপুরুষ, বাবা-মা, ভাইবোন, আত্মীয় বন্ধু সবাই এই দিনটি পালন করে। তারপরও মানতে হবে এত চেষ্টা-অপচেষ্টার পরেও ভাষা শহিদের দিন বা মাসের মর্যাদা কোনও অংশেই কমেনি। যে বা যারা যে উদ্দেশ্যেই বিদেশের একটি প্রথা এদেশে চালুর চেষ্টা করেছে তা বলতে হবে ভিন্ন ফল দিয়েছে। একুশের মর্যাদা বা গুরুত্ব কমানোর অপচেষ্টা কোনও কাজেই আসেনি। যদিও এসব কথা অনালোচিতই রয়ে গেছে। তবে আলোচিত হওয়াই বোধ করি যুক্তিযুক্ত। একুশের শিক্ষা সেই যে বলা হয়- ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’ সেই সত্য সেই শক্তি আবারও প্রমাণিত হয়, কোনও অপচেষ্টাই বাঙালির আত্মচেতনা দমিয়ে রাখতে পারবে না। সমস্ত অপশক্তির বিরুদ্ধে একুশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শেখায়। বাঙালির মাথা উঁচুই থাকবে যতদিন বাঙালি একুশের আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হবে।

ভালোবাসা দিবসের প্রধান উপাদান ফুল, একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহিদ দিবসেরও তাই। ফুল ভালোবাসার চিরন্তন প্রতীক। সর্বকালে সর্বসমাজে ফুল ভালোবাসতেই শেখায়। একুশেও ভালোবাসার কথাই শিক্ষা দেয়।

লেখকঃ সাংবাদিক