বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে তিস্তা নদীর পানি

19

বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভারি বৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢলের কারণে সৃষ্টি হয়েছে বন্যা। বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বিভিন্ন নদ-নদীর পানি। বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে তিস্তা নদীর পানি। এদিন নতুন করে কুশিয়ারা বিপদসীমা পার করে তিনটি স্থানে। সুরমাও ৩টি স্থানে বিপদসীমা পার করে প্রবাহিত হয়।

এছাড়া খোয়াই, সোমেশ্বরী, কংস, সাঙ্গু ও তিস্তা বিপদসীমার উপরে। এদিন অবশ্য দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় জেলার নদীগুলো বিপদসীমার নিচে চলে আসে। কিন্তু ফেনী, হালদা, মাতামুহুরী যে কোনো সময়ে বিপদসীমা পার করতে পারে। যমুনা ও ধরলার পানিও দ্রুত বাড়ছে।

ইতিমধ্যে দেশের ১০ জেলা বন্যা কবলিত হয়েছে। আগামী ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টায় আরও অন্তত ৩টি জেলা বন্যা আক্রান্ত হতে পারে।

বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে আগামী সপ্তাহের শেষ নাগাদ বানের পানিতে প্লাবিত হতে পারে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের নিম্নাঞ্চল।

এদিকে বন্যা কবলিত জেলাগুলোতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লাখো মানুষ। ডুবে গেছে গ্রামীণ সড়ক, ক্ষেতের ফসল। ভেসে গেছে মাছের খামার। বিভিন্ন স্কুলে পাঠদান বন্ধ হয়ে পড়েছে। এতে নিদারুণ দুর্ভোগে দিন কাটছে বানভাসী মানুষের।

সিকিম-আসামে ভারি বৃষ্টির কারণে তিস্তা এবং ব্রহ্মপুত্র-যমুনায় পানি প্রবাহ বেড়েছে। গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকায়ও পানি প্রবাহ বাড়তে পারে। আসাম-মেঘালয়ের বৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢলের পানি নেমে আসছে মেঘনা অববাহিকার বিভিন্ন নদীতে। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলেও ভারি বৃষ্টি অব্যাহত।

এতে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা, বগুড়া, নেত্রকোনা, সিলেট, সুনামগঞ্জ, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজার জেলায় বন্যা পরিস্থির অবনতি হয়েছে। আগামী ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টায় জামালপুর, সিরাজগঞ্জ এবং মানিকগঞ্জে বন্যা বিস্তৃত হতে পারে।

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে এ মুহূর্তে একটি মাঝারি ধরনের বন্যা চলছে। ইতিমধ্যে মেঘনা এবং ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা সক্রিয় হয়েছে।

সাধারণত এ দুই অববাহিকা একসঙ্গে সক্রিয় হলে ২৪-২৫টি জেলা বন্যায় আক্রান্ত হয়। তাই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে বড় বন্যা হয় উল্লিখিত দুই অববাহিকার সঙ্গে গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকা সক্রিয় হলে। ভারতের বিহারে এবং নেপালে বন্যা হচ্ছে।

এর কারণে গঙ্গায় পানি বাড়ছে। পদ্মায়ও প্রবাহ বাড়বে। কিন্তু এ বন্যার পানি বাংলাদেশকে আক্রান্ত কতটা করবে সেটার জন্য আরও দুই-আড়াই সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। যদি গঙ্গা-পদ্মায়ও বন্যা হয় তাহলে বাংলাদেশে বড় বন্যা হতে পারে। তবে আমি এখন পর্যন্ত তেমন আশঙ্কা দেখছি না।

৯ জুলাই থেকে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কয়েকটি রাজ্যে ব্যাপক বৃষ্টিপাত শুরু হয়। সেটি ৪ দিন ধরে অব্যাহত আছে।

পাশাপাশি বাংলাদেশেও ভারি বৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে প্রথম দিকে দেশের নেত্রকোনা, সিলেট, সুনামগঞ্জসহ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে পূর্বাঞ্চল হয়ে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল পর্যন্ত বিভিন্ন জেলা বন্যায় আক্রান্ত হয়।
বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এসব এলাকার ৭ নদী ১০টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপরে প্রবাহিত হয়। কিন্তু বৃষ্টিপাত বেড়ে যাওয়ায় শুক্রবার এসব নদী আরও নতুন নতুন এলাকায় বিপদসীমা পার করে প্রবাহিত হতে থাকে।

বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে দায়িত্বরত সরকারি প্রতিষ্ঠান বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানিয়েছেন, ভারি বৃষ্টির কারণে দেশের সব প্রধান নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব এবং ভারতের সিকিম, আসাম ও মেঘালয় রাজ্যে আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টায় মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টি হতে পারে।

এদিকে আবহাওয়া অধিদফতর (বিএমডি) জানিয়েছে, প্রায় সারা দেশেই ভারি বৃষ্টির আশঙ্কা আছে আরও দুই থেকে তিন দিন। আরেক পূর্বাভাসে বিএমডি বলেছে- রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, টাঙ্গাইল, রাজশাহীসহ বিভিন্ন জেলার ওপর দিয়ে দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে ঘণ্টায় ৪৫ থেকে ৬০ কিলোমিটার বেগে অস্থায়ীভাবে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ বৃষ্টি হতে পারে।

এসব এলাকার নদীবন্দরগুলোকে ১ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপদসীমার ১১ সেমি. ও ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ১২ সেমি.র উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি বাড়ছে তিস্তা ও দুধকুমারেও। চরাঞ্চলের দেড় শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েন প্রায় ৩০ হাজার মানুষ।

কুড়িগ্রাম সদরের চর যাত্রাপুরে গারুহারা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে পানি ঢুকে ৪টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার সবক’টি চরের আমন বীজতলা, পাট, ভুট্টা ও সবজি ক্ষেত নিমজ্জিত হয়েছে। নিচু এলাকার ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়ায় গবাদিপশু নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে।

এদিকে পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নদ-নদীর ভাঙন তীব্র রূপ ধারণ করছে। ধরলার ভাঙনে সারডোব বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধটি ভাঙনের মুখে পড়েছে। চিলমারীর নয়ারহাট ও অষ্টমীরচর ইউনিয়নের কয়েকটি চরে নদী ভাঙনে ২৪ ঘণ্টায় ৫০টি পরিবার গৃহহীন হয়েছেন।

দীঘিনালার নিচু এলাকা এখনও পানির নিচে। পানিবন্দি রয়েছেন মেরুং ইউনিয়নের ২০টি গ্রামের বাসিন্দা। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে মেরুং বাজার। শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত বন্ধ ছিল খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটি ও দীঘিনালা-লংগদু সড়কে যান চলাচল। পাহাড় ধসের শঙ্কায় সাজেক ভ্রমণে পর্যটকদের নিরুৎসাহিত করছে জেলা প্রশাসন।

চরফ্যাশন উপজেলার বিছিন্ন দ্বীপ ঢালচরে পানির তোড়ে গ্রামের কাঁচা রাস্তাগুলো ভেঙে গেছে। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। ডুবে গেছে অনেকের বসতভিটা, ফসলের ক্ষেত ও হাটবাজার। দক্ষিণ উপকূলের ঢালচরের বাগান থেকে শতাধিক মহিষ জোয়ারের টানে সাগরে ভেসে গেছে।