বাঁচতে হলে গাছ লাগানোর বিকল্প নেই

21

মোঃ জাবের হোসেন : জলবায়ু পরিবর্তন নতুন কোনো ঘটনা না। অতিতেও ছিলো বর্তমানে আছে আর ভবিষ্যতেও থাকবে। তবে ক্রমবর্ধমান হারে এই রীতির পরিবর্তন ঘটছে। আমরা শিশুকাল থেকেই শুনে এসেছি দেশে ৬ টা ঋতু। কিন্তু বর্তমানে ৩টার বেশি দেখা যায়না। এই যে ঋতুর পরিবর্তন, এটা কিন্তু আমাদের কারণেই।

যত মানুষ বাড়ছে ততই ঋতুর পরিবর্তন ঘটছে।কারণ অতিরিক্ত মানুষের বসবাসের জন্য প্রত্যাহ ঘর-বাড়ি তৈরির প্রয়োজনে গাছ কেটে, বন উজাড় করে ঘর তৈরি করা হচ্ছে। তার পরিবর্তে কিন্তু আমরা বৃক্ষ রোপন করছিনা। এই দায়ভারটা কিন্তু আমাদেরই। আমাদের উচিত যে হারে গাছ কর্তন হচ্ছে সে হারে গাছ লাগানো।

দেশের সবজায়গায় বায়ু দূষণ সমান না। কোনো কোনো জায়গায় কম-বেশি ক্ষেত্র বিশেষে।রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি বায়ু দূষিত হয়। গাছ-পালা নেই বললেই চলে সেখানে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার সুবিধার্থে কক্সবাজারে বন উজাড় করে আশ্রয় শিবির তৈরি হচ্ছে। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ কি হবে সেটি সবার জানা!

তবু কি আমরা সচেতন হচ্ছি? সহজেই উত্তর আসবে না। কোনো? প্রয়োজন মনে করিনা। বর্ষার সময় বর্ষা নেই, শীতের সময় শীত নেই।সারাবছরই উষ্ণতা। কৃষকেরা এখন আর আকাশের উপর ভরসা করে মাঠে ধান রোপন করতে পারেনা। কারন আবহাওয়ার ধরণটা এখন আর আগের মত নেই। আমরা নিজেরাই কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে ফেলছি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে হোক আর সরকারী উদ্যোগে হোক খুব কমই কিন্তু বৃক্ষরোপন কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়। বিভিন্ন সময় কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এনজিও নামমাত্র বৃক্ষরোপন কর্মসূচি পালন করে। যেটি প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগন্য।

সরকারীভাবে হোক আর ব্যক্তিগতভাবে হোক প্রতি বছর যদি একজন মানুষ একটি করে গাছ লাগাতো তাহলে হয়তো কিছুটা হলেও জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করা যেতো।

সরকারের “আশ্রয়ণ” নামে একটা প্রকল্প আছে।এই প্রকল্পের আওতায় ‘জায়গা আছে ঘর নেই’ এমন অসহায় মানুষের সরকারীভাবে ঘর তৈরি করে দেয়া হচ্ছে। এই প্রকল্পের ব্যায়টা কিন্তু বেশ বড়। এটা কিন্তু নিঃসন্দেহে সরকারের একটা উল্লেখযোগ্য প্রকল্প।

আমার মনে হয় বৃক্ষরোপণ বৃদ্ধি করার জন্য যদি এরকম একটা উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতো তাহলে হয়তো ভালো হতো। গতকাল আফ্রিকার একটি দেশ ইথিওপিয়ায় একদিনেই ৩৫ কোটি গাছ লাগিয়েছে। স্বয়ং সে দেশের প্রধানমন্ত্রী ওই প্রকল্পের তত্বাবধায়নে ছিলেন। এমনকি কিছু কিছু সরকারী অফিসও গাছ লাগানোর জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছিলো সরকার। এতেই কিন্তু তাদের পরিকল্পিনা শেষ হয়নি। তারা আরো স্থানীয় জাতের ৪ বিলিয়ন গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করেছে। এটা কিন্তু একবাক্যে শুধু ভালো উদ্যোগই নয়,ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, নিজেদের জন্য বাঁচার একটা পথ সৃষ্টি করেছে তারা।

বর্তমানে আমাদের দেশে বনজ সম্পদের পরিমাণ মাত্র ১৭%। যেটি হওয়ার কথা কোনো দেশের মোট স্থলভাগের ২৫ শতাংশ। এই যে ১৭% সেটা আগের হিসাবে। কিন্তু বর্তমানে যে হারে বন আর গাছ কর্তন হচ্ছে তাতে নতুন করে যদি জরিপ করা হয় তাহলে আমার মনে হয় হারটা আরো অনেক কমে যাবে।এটি কিন্তু ক্রমেই বাড়ছে। যেটি আমাদের জন্য একসময় কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাবে বসবাসের।

গাছপালা যে শুধু আমাদের অক্সিজেন দেয় তা না। গাছপালা প্রকৃতিক বিভিন্ন দুর্যোগ থেকেও রক্ষা করে। গাছপালা ছাড়া জীবন ধারণ অসম্ভব। ইসলামে বৃক্ষ রোপনের তাগিদ দেয়া হয়েছে। সহিহ্ বোখারি হাদিসে বলা হয়েছে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “কোনো ব্যক্তি যদি বৃক্ষ রোপন করে অথবা ফসল উৎপন্ন করে আর তা থেকে যদি মানুষ ও পশু-পাখি ভক্ষণ করে, তাহলে উৎপন্নকারীর আমলনামায় তা সদকার সওয়াব হিসেবে গণ্য হবে।” এ থেকে বোঝা যায় ইসলামে বৃক্ষ রোপন কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

উষ্ণায়নের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে সহজেই অনুমেয় যে, বর্তমান শতাব্দীতে তাপমাত্রা সব থেকে বেশি বাড়ছে। এক হিসাবে দেখা গেছে ১৮৬০-১৯০০ সালের তুলনায় ভূ-ভাগ ও সমুদ্র উভয় ক্ষেত্রেই বিশ্বের তাপমাত্রা ০.৭৫° সে. (১.৪° ফা.) বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭৯ সাল থেকে ভূ-ভাগের তাপমাত্রা মহাসাগরের তাপমাত্রার চেয়ে দ্বিগুণ দ্রুততায় বৃদ্ধি পেয়েছে (দশকে ০.১৩° সে. এবং স্থলে ০.২৫° সে.)।

কৃত্রিম উপগ্রহকৃত তাপমাত্রা পরিমাপ হতে দেখা যায় যে, নিম্ন ট্রাপোমণ্ডলের তাপমাত্রা ১৯৭৯ সাল থেকে প্রতি দশকে ০.১২°সে.-০.২২°সে. সীমার মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৮৫০ সালের এক বা দুই হাজার বছর আগে থেকে তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল ছিল। তাছাড়া সম্ভবত মধ্যযুগীয় উষ্ণ পর্ব কিংবা ক্ষুদ্র বরফযুগের মত কিছু আঞ্চলিক তারতম্য ঘটেছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের নাসা’র (NASA) গডার্ড ইনস্টিটিউট ফর স্পেস স্টাডিজ-এর (Goddard Institute for Space Studies) করা অনুমিত হিসাব অনুযায়ী ১৮০০ শতকের শেষের দিক থেকে নির্ভরযোগ্য তাপমাত্রা মাপক যন্ত্রের ব্যাপক বিস্তার লাভের পর ২০০৫ সাল ছিল সবচেয়ে উষ্ণ বছর। যা ইতিপূর্বে লিপিবদ্ধ উষ্ণতম ১৯৯৮ সাল থেকে এক ডিগ্রীর কয়েক শতাংশ বেশি উষ্ণ।

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (WMO-World Meteorological Organization) এবং যুক্তরাজ্য জলবায়ু গবেষণা ইউনিট (CRU-Climate Research Unit) একটি অনুমিত হিসাব থেকে ২০০৫ সালকে ১৯৯৮ সালের পরে দ্বিতীয় উষ্ণতম বছর হিসেবে বিবৃত করেছে।

শেষ ৫০ বছরে সবচেয়ে বিস্তারিত উপাত্ত আছে। আর এই সাম্প্রতিক সময়েই জলবায়ু পরিবর্তনের ধরণটা (attribution of recent climate change) সবচেয়ে স্পষ্ট। এটা মনে রাখুন যে, মনুষ্য সৃষ্ট অন্যান্য দূষনকারী বস্তুর নিঃসরণ-বিশেষত সালফেট কণা-একটি শৈত্যয়ন ক্রিয়া ঘটায়। এটা বিশেষ করে দ্বাদশ শতকের মালভূমি/শৈত্যয়নের জন্য দায়ী। যদিও এটা প্রকৃতির স্বাভাবিক জলবায়ু চক্রের কারণেও হতে পারে।

এর সমাধান কিন্তু আমাদের কাছেই রয়েছে। শুধু প্রয়োজন নিজেদের সদিচ্ছা আর ইচ্ছাশক্তি।আমাদের আরো বেশি সচেতন হতে হবে। কালো ধোঁয়া বন্ধ করতে হবে।সিএফসি নির্গত হয় এমন যন্ত্রপাতির ব্যবহার কমাতে হবে।জীবাশ্ম জ্বালানির ব‍্যবহার নিয়ন্ত্রণ। সর্বপরি গাছ লাগাতে হবে। নিজেদের জন্য নিজেকে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, লাল সবুজের কথা

ইমেইল-zaberhossen94@gmail.com