বঙ্গবন্ধুর সৈনিকরা ভয় পায় নাঃ ড. কামাল

35
জাতীয় ঐক্য

জনগণের হাতে দেশের সত্যিকার মালিকানা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে ৭ দফা দাবি এবং তা বাস্তবায়নে ১১ দফা লক্ষ্য ঘোষণা করেছে নতুন জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।

শনিবার সন্ধ্যায় জাতীয় প্রেসক্লাবে ঐক্যফ্রন্টের ঘোষণা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংবিধান প্রনেতা ও গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন।

এ সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাকে কিছু না দিলেও স্বৈরাচারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার শিক্ষা দিয়েছেন। মানুষের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে পারি।

‘‘তাই ভয় দেখিয়ে কাজ হবে না। কেউ যদি গুলি করতে চায়, তাহলে করুক। আমাদের কোটি কোটি জনগণ। কার কাছে কতো গুলি, কতো ট্যাংক আছে নিয়ে আসুক। বঙ্গবন্ধুর সৈনিকরা ভয় পায় না।

কামাল হোসেন আরো বলেন: দেশের সকল মানুষের স্বার্থে, জাতীয় স্বার্থে এই ঐক্যের ডাক। কোটি কোটি মানুষের পক্ষে এই উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা ইতিহাসে দেখেছি ঐক্যের মধ্য দিয়ে বিজয় আসে।

‘‘আমরা ঝুঁকি নিয়ে আজকে এখানে বসেছি। কোনো সময় নষ্ট করা যাবে না। ঐক্য প্রক্রিয়াকে জেলায় জেলায় জনগণের কাছে নিয়ে যেতে হবে। আমাদের ঐক্য জনগণের ঐক্য। জাতি ঐক্যবদ্ধ হলে বিজয় আসে। ৬ দফা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন তার দৃষ্টান্ত।’’

তিনি বলেন, ব স্বৈরাচারের বিরুদ্ধ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের লড়াই অবশ্যই চলবে। জাতীয় ঐক্য জনতার ঐক্য, এই ঐক্য কেউ ভাঙতে পারবে না। এটা কোনো দলীয় রাজনীতি না। এটি জনগণের পক্ষে, জনগণ যে দেশের মালিক, সে মালিকানা প্রতিষ্ঠা করে দিতে আজ এই ঐক্য।

জনগণেরই শুধু সরকার গঠনের অধিকার আছে জানিয়ে ড. কামাল বলেন, অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করবে তারাই সরকার গঠন করবে। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে তাদের সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি ঐক্যফ্রন্টে। যারা দেশে লুটতরাজ করেছে তারা ঐক্যবদ্ধ জনগণকে দেখলে পালাবে। আমাদের কোনো কথা নেই। তারা চলে যাক। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে হবে।

তিনি আরো বলেন: সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলতে চাই, মানুষের ভোটাধিকারের জন্য নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। দেশের মালিক জনগণ৷ কালো টাকার বিনিময়ে, সাম্প্রদায়িকতার বিনিময়ে, পেশীশক্তির বিনিময়ে যারা ক্ষমতায় আসতে চায় তাদেরকে নয়, আমরা জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে চাই৷

মির্জা ফখরুল
এসময় বিএনপির পক্ষ থেকে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ উপস্থিত ছিলেন৷

বিএনপি মহাসচিব বলেন: আজকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নবসূচনার দিন৷ কেননা জাতি গণতন্ত্রের জন্য ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছিলো। সে জাতি আজকে গণতন্ত্রবিহীন, সে জাতি প্রতিনিয়ত স্বৈরাচারের অত্যাচারে নিপীড়িত। সে জাতির মুক্তির জন্য গণ মানুষের আন্দোলনে নতুন সূচনা হলো আজ।

ফখরুল বলেন: আমরা এখন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি একটি মুক্ত দেশের, সমাজের৷ মানুষ একটি সুস্থ সুন্দর গণতান্ত্রিক দেশ চায়৷ আজকের এ লড়াই নতুন করে শুরু হলো। আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছি এবং শপথ নিয়েছি যে, গণতন্ত্রের অধিকারগুলোকে আদায় করে ঘরে ফিরবো।

ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন
বলেন: জাতির জন্য, ভবিষ্যৎ দেশের জন্য আজকের দিনটি অত্যন্ত সুন্দর ও যুগান্তকরী ঐতিহাসিক দিন। আজকে আমরা অত্যন্ত কঠিন সময়ে বাস করছি৷ আজকে লুটেরাদের দখলে দেশ। এমন একটি সময়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশ যে অন্ধকারে ধাবিত হচ্ছিল সেখানে আশার আলো হিসেবে এই ঐক্যফ্রন্ট যাত্রা করলো।

মওদুদ আহমদ
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন: আজকে দেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন। গণতন্ত্র, মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ইতিহাসের একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে কাজ করবে। ড. কামাল হোসেন এ বয়সে এমন একটি সাহসি উদ্যোগ নিয়ে প্রমাণ করেছেন দেশকে ভালোবাসেন। এই ঐক্যের মধ্যদিয়ে স্বৈরাচারী সরকারকে বাধ্য করা হবে দাবি মানতে।

আসম আব্দুর রব
বলেন: জনগণ কর্তত্ববাদী, স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী থেকে মুক্তি চায়। জনগণ আতংকিত, শঙ্কিত। আজকে কেউ নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারবে কিনা কেউ জানে না। এমন একটি সময়ে এই ঐক্য৷ একাত্তরে জাতীয় ঐক্য ছিলো বৃহত্তর ঐক্য। কিন্তু ১৯৭২ সালে তা নষ্ট করা হয়। এরপর আজকে আরেকটি বৃহত্তর ঐক্য হলো।

‘‘আগামীকাল থেকে দেশের সকল দল, মত, পথ, গোষ্ঠী আমাদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। আজকে আপনাদের এই ভালোবাসা, এই সাড়া এই দেশের মাটি থেকে স্বৈরতন্ত্রকে আমরা দেশের মাটি থেকে উৎখাত করতে পারবো। আগামী দিনে জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে দেশে আর কোনো দলীয় সরকার আসতে দেয়া হবে না।’’

মাহমুদুর রহমান মান্না
জোটের ৭ দফা এবং ১১ লক্ষ্য ঘোষণা করে বলেন: আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করতে চাই যে, বেশ কিছুদিন ধরে চেষ্টা করছিলাম একত্রে হওয়ার। তার আজকে একটি সফল পরিণতি হয়েছে৷ সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ না হলে এই লড়াইয়ে সফল হওয়া যাবে না৷ এই প্রত্যয় ঘোষণা করছি যে, এই স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক লড়াই শুরু হলো।

দাবি
১. সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারের পদত্যাগ, জাতীয় সংসদ বাতিল, সব রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার গঠন, খালেদা জিয়াসহ রাজবন্দীদের মুক্তি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার নিশ্চিত করা।

২. যোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন ও নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করা।

৩. নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা।

৪. শিক্ষার্থী, সাংবাদিকসহ সবার বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ সব কালো আইন বাতিল।

৫. নির্বাচনের ১০ দিন আগে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন।

৬. দেশী ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগ ও গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ না করা।

৭. নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার তারিখ থেকে ফলাফল চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত চলমান সব রাজনৈতিক মামলা স্থগিত রাখা ও নতুন কোনো মামলা না দেয়া।

জাতীয় ঐক্য

১১ লক্ষ্য
১। মুক্তি সংগ্রামের চেতনাভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিদ্যমান স্বেচ্ছাচারী শাসনব্যবস্থার অবসান করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা।

২। ৭০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের যুগোপযোগী সংশোধন করা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা নিশ্চিত করা।

৩। দুর্নীতি দমন কমিশনকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার নিশ্চিত করা।

৪। দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিবেশ সৃষ্টি, সব নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা ও মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চয়তার বিধান করা।

৫। জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও স্থানীয় সরকারসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতি ও দলীয়করণের কালো থাবা থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে এসব প্রতিষ্ঠানের সার্বিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও কাঠামোগত সংস্কার সাধন করা।

৬। রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, জনগণের আর্থিক স্বচ্ছতা ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ রাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শৃঙ্খলা নিশ্চিত।

৭। জাতীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার, সুষম বণ্টন ও জনকল্যাণমুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা।

৮। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জাতীয় ঐকমত্য গঠন এবং কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে না দেয়া।

৯। ‘সব দেশের সাথে বন্ধুত্ব- কারো সাথে শত্রুতা নয়’ এই নীতির আলোকে জনস্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তা সমুন্নত রেখে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা।

১০। বিশ্বের সব নিপীড়িত মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকার ও সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন এবং মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তাদের দেশে ফেরত ও পুনর্বাসনের কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা।

১১। দেশের সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সুরক্ষার লক্ষ্যে প্রতিরক্ষা বাহিনী আধুনিক প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ও সমর-সম্ভারে সুসজ্জিত, সুসংগঠিত ও যুগোপযোগী করা।

এতে আরো উপস্থিত ছিলেন ডা. জাফর উল্লাহ চৌধুরী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন, গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু, অ্যাডভোকেট সুব্রত বড়ুয়া প্রমুখ।