নৈতিকতা অবক্ষয়ের কারণ ও তার প্রতিকার

5650

মু.হামিদুর রশিদ জামিলঃ নৈতিকতা(ইংরেজি: “Morality”) (ল্যাটিন শব্দ “মোরালিটাস” থেকে আগত, যার অর্থ চরিত্র, ভদ্রতা, সঠিক আচরণ) হল ভাল(বা সঠিক) এবং খারাপ(বা ভুল) বিষয়সমূহের মাঝে উদ্দেশ্য সিদ্ধান্ত ও প্রতিক্রিয়াসমূহের পার্থক্য ও পৃথকিকরণ।

নৈতিকতাকে একটি আদর্শিক মানদন্ড বলা যেতে পারে যা বিভিন্ন অঞ্চলের সামাজিকতা, ঐতিহ্য, সংষ্কৃতি, ধর্ম প্রভৃতির মানদন্ডের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে| আবার অনেক ক্ষেত্রে, সামগ্রিকভাবে সমগ্র পৃথিবীর জন্য কল্যাণকর বিষয়সমূহকেও নৈতিকতা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়|

ধর্মীয় বিধি-বিধান বা নিয়ম-কানুন মেনে চলা ও রক্ষা করা থেকেই নীতি, মূলনীতি বা প্রণালী অর্থাৎ নিয়মের মূলতত্ত্ব ও উপাদানই নীতি। ইসলামের রীতিনীতির প্রতি যথাযথ মূল্যায়ন, সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন থেকেই আসে নীতিবোধ ও আদর্শিক গুণাবলি। আর এই নীতিবোধ থেকেই নৈতিকতা।

মানব জীবনের সকল পর্যায়ে নৈতিকতার বিধানকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে ইসলাম। নৈতিকতাই মানুষের জীবনের সব দিক ও বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানব জাতির সহজাত মৌলিক প্রবৃত্তি ও মনোবৃত্তিই হলো নিয়ম-কানুন।

একদিক থেকে মানুষ প্রকৃতির অংশ বা প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন। সুতরাং ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ তথা সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ হিসেবে আত্মমর্যাদা বহাল রাখতে এবং মহৎ জীবনের অনুসন্ধান করতে হলে প্রাকৃতিক নিয়ম ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে হবে।

ধর্মীয় বিধি-বিধান বা নিয়ম-কানুন মেনে চলা ও রক্ষা করা থেকেই নীতি, মূলনীতি বা প্রণালী অর্থাৎ নিয়মের মূলতত্ত্ব ও উপাদানই নীতি। ইসলামের রীতিনীতির প্রতি যথাযথ মূল্যায়ন, সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন থেকেই আসে নীতিবোধ ও আদর্শিক গুণাবলি। আর এই নীতিবোধ থেকেই নৈতিকতা।

অর্থাৎ নিয়ম থেকে নীতি, আর নীতি থেকে নৈতিকতা। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে নৈতিকতার বিধানগুলো সর্বাঙ্গীন সুন্দরভাবে বিধৃত আছে। মানুষকে যে ভালো কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজে বিরত রাখার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে, ‘তোমারই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির জন্য তোমাদের আর্বিভাব হয়েছে, তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দিবে, অসৎ কাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করবে।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১১০)

মানুষের নৈতিক চেতনা বিকাশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সামাজিক জীবন ও প্রতিষ্ঠানাদি যেমন, নৈতিক চেতনাও তেমনি ধাপে ধাপে ক্রমান্বয়ে বিকশিত হয়েছে। যেমন-শুরুতে আদিমানবের ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত প্রভৃতি মূল্যবোধক চেতনা ছিল খুবই অস্পষ্ট।

এ পর্যায়ে যুক্তি বিচারের চেয়ে অন্ধ প্রবৃত্তি ও ভাবাবেগ ছিল প্রবল; আর এ প্রবৃত্তি ও আবেগের বশবর্তী হয়েই মানুষ তখন যাবতীয় কাজ ও ভালো-মন্দের বাছ-বিচার সম্পন্ন করতো। এখানে নীতিবোধ ও মূল্যবোধের চেয়ে প্রয়োজন ও আত্মস্বার্থই মুখ্য ছিল। প্রকৃতির রাজ্যে যা কিছু আছে, এর সবগুলোতেই ব্যক্তি দাবি করতো অবাধ অধিকার।

এমন ভাবনা থেকেই সবাই নিজ নিজ স্বার্থ হাসিল করতে সচেষ্ট থাকতো। এ অবাধ প্রতিযোগিতা থেকে স্বাভাবিক কারণেই মানুষে মানুষে কলহ-বিবাদ ও হানাহানি শুরু হতো, যুদ্ধ বিগ্রহ বেধে যেত। দুনিয়াতে অশান্ত যুদ্ধাবস্থা সার্বক্ষণিক চলতে থাকে; ফলে ক্রমশ সর্বত্র যে কারো আকস্মিক মৃত্যুর আশংকা ছড়িয়ে পড়ে।

এহেন দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে সবল, দুর্বল কারো মধ্যেই ছিল না শান্তি ও নিরাপত্তাবোধ। ফলে সকলের নিরাপত্তার স্বার্থেই সম্পাদিত হয় সামাজিক চুক্তি এবং প্রণীত হয় প্রয়োজনীয় সব নিয়ম-কানুন। এভাবে আদিম মানুষের পারস্পরিক স্বার্থ সুরক্ষার প্রয়োজনবোধ থেকেই সূত্রপাত ঘটে নৈতিক চেতনা। এ থেকেই ক্রমশ গড়ে ওঠে নীতিবিদ্যার মৌলিক বিধি-নিয়ম।

নৈতিকতা হলো নীতিবোধ ও গুণাবলির দর্শন অর্থাৎ জীবন দর্শন। মানবজীবনকে সুপথে ভালোকাজে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতা একটি প্রশিক্ষণ। এটা শেখার জন্য ব্যবস্থা, অনুশীলন ও চর্চার প্রয়োজন।

মানুষের জীবনের সততা, মহানুভবতা, উদারতা, ন্যায়পরায়নতা, সভ্যতা, সাধুতা, অখন্ডতা, একত্রতা, পূর্ণতা সর্বোপরি সচ্ছতা, জবাবদিহিতা চরিত্র মহত্ত্ব ও আদর্শিক গুণাবলির সংমিশ্রিত আত্মশুদ্ধির ফসল হচ্ছে নৈতিকতা। জীবন চেতনার প্রথম সূর্যসিঁড়ি নৈতিকতা মানুষের জীবনের স্বচ্ছতার দিগন্তবিস্তারী প্লাবন ডেকে এনে দেয়।

তাই মানুষের বিবেক ও মূল্যবোধের জাগরণকেই নৈতিকতা বলা হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) যথার্থই বলেছেন, ‘সুন্দর নৈতিক চরিত্র ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়ার চেয়ে উত্তম কিছুই পিতামাতা সন্তানদের দান করতে পারে না।’ (তিরমিজি)

নৈতিকতা অর্জন ব্যতিরেকে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও নির্মূল করা করা কখনও সম্ভব নয়।

নৈতিকতা সমস্ত অন্যায়, অত্যাচার, নিপীড়ন ও নির্মমতার আঘাত থেকে রক্ষা করার জন্য এক সাহসী ও প্রতিবাদী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।

মানুষের জীবন গড়ার মাধ্যম হলো নৈতিকতা। জাতির সর্বক্ষেত্রে অবক্ষয় রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই নৈতিকতা।

কিন্তুু দুঃখের বিষয়, দেশে আজ সততা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও নৈতিকতার দুর্ভিক্ষ চলছে। নৈতিক সংকটের আবর্তে ক্লিষ্ট ভাগ্যাহত মানুষের জীবনের পরতে পরতে একটা সত্য অবিরত আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে যায়, তা হচ্ছে ইসলাম ধর্মের মর্মবাণীর মধ্যে আল্লাহর দেওয়া পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা সর্বাত্মকভাবে গ্রহণ করতে পারলে পৃথিবীটা প্রকৃত সুখের ও শান্তিময় হয়ে উঠতো।

নৈতিকতা সেই তাগাদা ও মহান শিক্ষা নিয়ে আসে। তাই নৈতিকতা বিশ্বাসের, আত্মপ্রত্যয়ের ও আত্মোপলব্ধির চেতনালব্ধ সহজ সত্যের সরল স্বীকারোক্তি ও প্রতিশ্রুতি। মানুষ তার সমকালীন প্রথা প্রচলনকে নতুন করে বিচার-বিশ্লেষণ এবং যুক্তির আলোকে সংশোধন করতে পারে।

এভাবে প্রচলিত প্রথার প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও সংশোধনের মধ্য দিয়ে ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে মানবসভ্যতা। নবী করিম সা. নৈতিকতার মহিমা তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে আমার কাছে অধিক প্রিয় এবং কিয়ামতের দিন মর্যাদার দিক থেকে অধিক নিকটবর্তী সেই ব্যক্তি, যে তোমাদের মধ্যে আখলাক ও নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে উত্তম।’ (তিরমিজি)

মানুষের অধিকার নিশ্চিত হয় পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে। আর তাই নিজে বাঁচ, অন্যকে বাঁচতে দাও, দুষ্কর্ম ছেড়ে সদাচরণের পক্ষে এসো- এসব প্রাথমিক নীতির ভিত্তিতেই রচিত হয় আদিকালের নৈতিক মানদণ্ড।

দিকে দিকে বিশ্বায়নের যে জয়ধ্বনি শোনা যাচ্ছে, এর একটা প্রভাব নৈতিকতার ক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে নানারকম ভেদ-বিভেদের মধ্যেও অনেকেই বিশ্বজনীন নৈতিক চেতনার এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সব মানুষের ঐক্য ও সদ্ভাব-সম্প্রীতির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন।

যারা পারস্পরিক সদ্ভাব, সম্প্রীতি ও সহযোগিতা প্রদর্শন করেছে, তারাই প্রকৃতি দ্বারা নির্বাচিত হয়েছে এবং তীব্র প্রতিযোগিতামূলক জীবন সংগ্রামে টিকে থেকেছে।

পরিবার ও গোত্রীয় পর্যায়ের নৈতিকতার মধ্য দিয়ে নীতিবোধসম্পন্ন মানুষ অন্যান্য প্রাণীর প্রবৃত্তিমূলক নির্বিচার জীবনের পর্যায় অতিক্রম করে ক্রমশ অধিকতর সংহত নৈতিকতার স্তরে উন্নীত হয়েছে।

নৈতিক মূল্যবোধ সুস্থ ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটিয়ে প্রাণের পরশ জাগায়। নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাবে পারিবারিক বন্ধন ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি সামাজিক অস্থিরতার কারণে জীবনে বাড়ছে হতাশা, মানসিক বিষন্নতা, আর্থিক দৈন্য। ফলে সমাজে বেড়েই চলছে অপরাধ। নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে শিশু সন্তানেরাও। পারিবারিক কলহ, রাজনৈতিক বিরোধ, পরকীয়া, ছিনতাইকারীর আক্রমণ ও পেশাদার অপরাধী গ্রুপের অভ্যন্তরীণ বিরোধে ঘটছে খুনের ঘটনা। এসব ঘটনায় স্থানীয় জনমনে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা। দিন কাটছে নানা আতঙ্কে।

কিশোরদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ চুরি, হত্যা, আত্মহত্যা,ধর্ষণ, ছিনতাই, পকেটমার, মাদক সেবন, ইভটিজিং সহ এমন সব ভয়াবহ কাজ ও অঘটন ঘটিয়ে চলছে এবং এমন লোমহর্ষক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে যা অকল্পনীয়।

কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির কারণ কী? তা নির্ণয় করা এখন জরুরি। নৈতিকতাবোধের অভাব, শিক্ষার মান নিম্নমুখী,পরিবারে আদর্শের অভাব, নেশা ও মাদকতার দিকে অতি আকর্ষণ, আদর্শহীনতা তদুপুরী সাধারণ বিনোদনের অভাব।

কিশোরদেরকে এ অবস্থা হতে উত্তরণের জন্য শারীরিক,মানসিক ও নৈতিক বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষা, খেলাধুলা,স্কাউটিং ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ তৈরী করা জরুরি। সাথে সাথে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং আদর্শিক মূল্যবোধ সৃষ্টির জন্য প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করা প্রয়োজন। তাঁদের মাঝে আত্মবিশ্বাসও আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা নিতে হবে। এতে তারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে পরিবর্তে সৃজনশীল কাজে বেশি উৎসাহী হবে। পরিবার ও অভিভাবকদের আরো বেশি যত্নশীল ও সচেতন হতে হবে।

কিশোর অপরাধ যে ভয়ানক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের মাঝে যারা আদর্শ ও শিক্ষাদাতার ভূমিকা পালন করছেন তাঁদের দায়িত্ব অনেক। সমাজকে অবক্ষয়মুক্ত করতে হলে আমাদের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারীদেরকে নৈতিকতার শিক্ষায় ও আদর্শে শিক্ষিত করতে হবে। প্রকৃত শিক্ষা ব্যবস্থায় কিশোরদেরকে মৌলবাদ,জঙ্গীবাদ, অপরাধ প্রবণতা ও মাদকের নেশা হতে মুক্তি দিতে পারে। যুবকদের সংশোধন ব্যতিরেকে কোন জাতিই উন্নতি করতে পারে না।

অবক্ষয় শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘ক্ষয়প্রাপ্তি’। সামাজিক মূল্যবোধ তথা সততা, কর্তব্য পরায়নতা, নিষ্ঠা, ধৈর্য, উদারতা, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, নান্দনিক সৃজনশীলতা, দেশপ্রেম, কল্যাণবোধ, পারস্পরিক মমতাবোধ ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলী লোপ পাওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়াকে বলে সামাজিক অবক্ষয়।

আজকের পৃথিবীর দিকে তাকালে দেখতে পাই বিশ্বব্যাপী পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং শিক্ষাঙ্গনসহ সর্বক্ষেত্রে অবক্ষয়ের ছাপ। নৈতিক মূল্যবোধগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। ভীতসন্ত্রস্ত, অশান্তি ও অস্থিরতা বাড়ছে পুরো পৃথিবী জুড়ে। ফলে পারিবারিক কলহ, অবাধ যৌনাচার, অশ্লীলতা, যৌন বিকৃতি, কুরুচিপূর্ণ সমকামী ও বহুকামিতার মতো পশুসুলভ যৌন আচরণ সমাজকে নিয়ে যাচ্ছে অবক্ষয়ের দ্ধারপ্রান্তে।

সোস্যাল মিডিয়া ফেইসবুক, ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া ও প্রিন্ট মিডিয়ার খবরের প্রায় ৫০% খবরই সমাজিক অবক্ষয়ের। পত্রিকা পাতা খুললেই চোখে পড়ে স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন, স্ত্রীর হাতে স্বামী খুন, প্রেমিকার হাতে প্রেমিক খুন, প্রেমিকের হাতে প্রেমিকা খুন, ভাইয়ের হাতে ভাই খুন, ছেলের হাতে মা খুন, দোলা ভাইয়ের হাতে শালী খুন, পুত্রের হাতে পিতা খুন ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার খুন, ধর্ষণ, গুমের খবরও কম নয়। বিশেষ করে শিশু ধর্ষণের খবর দেশের সর্বত্রই চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।

যেখানে নৈতিকতা অনুপস্থিত সেখানে সামাজিক অবক্ষয় সবচেয়ে বেশী। দেশের সর্বাঙ্গে আজ নৈতিকতার অনুপস্থিতির কারণে এ অবক্ষয় দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে নীপিড়নে স্বীকার, পদ পদবীর লোভে মানুষ নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ হচ্ছে, দেশের সর্বত্র মাদকের জয় জয়কার ধ্বনি। দেশে যে প্রান্তে থাকুক না কেন মাদক যুব সমাজকে গ্রাস করছে। মাদকাশক্ত ব্যক্তিরাই সমাজিক অবক্ষয় সৃষ্টি করছে। বিবাহ বন্ধনে গঠিনতম পদ্ধতি অবলম্বনের ফলে বিবাহ বর্হিভূত সম্পর্ক, বিবাহ পূর্ব সম্পর্ক, বিবাহ পরে পরকীয়া, যথাসময়ে বিবাহ সম্পন্ন না হওয়া, একক সিদ্ধান্তে বিবাহ দেয়া ইত্যাদি সমাজের রন্দ্রে রন্ধ্রে প্রবিষ্ট হয়ে গেছে যার কারণে সমাজিক অবক্ষয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়াও সম্পদের লোভ, ন্যায় বিচারের অনুপস্থিতি, সহশিক্ষা, নৈতিক শিক্ষার অভাব, নারীদের বৈচিত্রময়, উলঙ্গ, অর্ধউলঙ্গ পোষাক ও সমাজে হালাল হারামের অনুপস্থিতি সামাজিক অবক্ষয়ের মূল কারণ।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইস ববুকের মাধ্যমে এই সামাজিক অবক্ষয় সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে যুব সমাজ আরো বেশী এ অবক্ষয়ে পা বাড়াচ্ছে। পর্ণোগ্রাফি, ভিড়িওগ্রাফি ছাড়াও বর্তমান সময়ে কুরুচিপূর্ণ ভিড়িও আপলোড করে ফেইসবুকে যা দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে দেশে-বিদেশে। যুব সমাজের হাতের মুঠোয় আজ বিশ্ব। ডিজিটাল এ যুগে ফেইস বুক একাউন্ট প্রতিটি যুবকেরই আছে। ফেইসবুকে নগ্ন এসব ভিডিও দেখে তরুণপ্রজন্ম অবক্ষয়ের সাথে জড়িয়ে পড়ছে।

এ সব ফুটেজগুলোতে অংশ নেয়া ছেলে-মেয়েরাও যেমন এ সমাজের অংশ। তেমনি যারা এর ক্রেতা তারাও এ সমাজেরই অংশ, এর সিংহভাগই আবার তরুণ প্রজন্ম। যারা স্বাধীনতার নামে আধুনিকতার দোহাই দিয়ে বেহায়াপনার শেষ সীমা অতিক্রম করে চলেছে নিত্য।

আমরা জেনেও এর প্রতিকারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ না করে বরং তাদের সহযোগিতাই করে চলেছি দায়িত্বজ্ঞানহীন অপদার্থের মতো। যে ছেলেটি তার মোবাইলে এই ভিডিও ফুটেজগুলো দেখে রাস্তায় বের হয় তার কাছে সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া মেয়েটি আর ফুটেজে দেখা মেয়েটিকে একই মনে হবে এটাই স্বাভাবিক। আর তখন যে সে ওই মেয়েটিকে হেনস্তা করতে চাইবে; ইভটিজিং করবে এটাও কি স্বাভাবিক নয়? আমাদের নাটক-সিনেমার গানে তুমি-আমি ছাড়া কিছু নেই। মোবাইল কোম্পানিগুলো তাদের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সেটাকে উসকে দিচ্ছে আরও। ভাবখানা এমন, যেন বন্ধু পাশে থাকলেই হলো আর কারো প্রয়োজন নেই, বন্ধুত্ব মানেই প্রেম। প্রেমের জন্যই জীবন, আর প্রেম মানেই বেহায়াপনা। জীবনের আর কোনো লক্ষ্যই নেই! ঠিক একইভাবে ইন্টারনেট মানেই ফেসবুক, ফেসবুক মানেই ফেক আইডি আর মিথ্যের ছড়াছড়ি! বন্ধুত্ব-প্রলোভন, প্রেম অতঃপর বাস্তবতার ঘাড়ে রক্তাক্ত অন্তর। এরপরে নেশা। বলে রাখা ভালো, ফেসবুকেও আছে জ্ঞানগর্ভ অনেক ভালো ভালো পাতা। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো তার পাঠক সংখ্যা নেহায়েতই নগণ্য। এই ভাবে তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহারের ফলে যুবসমাজ অবক্ষয়ের পথে এগিয়ে চলেছে।

আবার নারীদের পোষাক ও চলাফেরার ক্ষেত্রেও অবক্ষয়ের কারণ। দেশের প্রতিটি পার্ক ও দর্শনীয় স্থান গুলোতে প্রেম বিনিময়, প্রেমিক প্রেমিকা জুটি বেঁধে প্রকাশ্য অসমাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে। আবার আলো-আধারী কিছু হোটেল, মিনি চাইনিজ রেষ্টুরেন্ট, সাইবার ক্যাফ গুলোতেও অসামাজিক কার্যকলাপ নিরবিচ্ছিন্নভাবে চলছে। এসব প্রতিষ্ঠান গুলোতে ২৪ঘন্টাই অসামাজিক কার্যকলাপ চললেও আইনের কোন প্রয়োগ নেই।

খ্যাতিমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অধিকাংশ বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে ইভটিজিং, নারীদের উত্্যক্ত করণ, খুন, ধর্ষণের মতো ঘটনা নিত্যনৈমিত্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান সময়ে যে কোন পার্কের পরিবেশ এমনই যে সাধারণ মানুষ ইতস্ততবোধ করতে বাধ্য হয়। সংস্কৃতির আগ্রাসান ও অপসংস্কৃতির কারনেও সামাজিক অবক্ষয় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে ভারতীয় চ্যানেল জি সিনেমা, স্টার প্লাস, স্টার জলসা, সিআইডি ইত্যাদি ইত্যাদি অনুষ্ঠানে যা সম্প্রচার করা হয় তা থেকে সমাজের শিখার কিছুই নেই বরং ভাবীর সাথে দেবরের সম্পর্ক, পরকীয়া, ননদ-ভাবীর ঝগড়া, বউ-শাশুড়ীর অমিল, সম্পদের ভাগ-ভাটোয়ারা, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে খারাপ আচরণ ইত্যাদি শিক্ষাই বেশী শিখছে। ফলে তা সমাজের মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত।

৬ষ্ট, ৭ম, ৮ম শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থী স্বাভাবিকভাবে যৌনতা কিংবা তার অনুভূতি জানার কথা নয়। কিন্তু গার্হস্থ্য অর্থনীতির ও সামাজ পাঠ্য বইয়ে যৌতনতার অনুভূতি সৃষ্টির কতক শব্দ ও ধারণা দিয়ে এ সব কোমলমতি শিশুদের যৌনতার দিকে ধাবিত করা হচ্ছে। সম্প্রতি সামাজিক অবক্ষয়ের কিছু চিত্র যা ভয়ালরূপ ধারণ করেছে। ২০১০ সালের ২১জুন রাজধানীর আদাবরে মায়ের অনৈতিক সম্পর্ক দেখে ফেলায় মা আয়েশা হুমায়রা নিজের হাতে খুন করে সাড়ে পাঁচ বছরের শিশু সন্তান খন্দকার সামিউলকে। একই কারণে গত ৩১ অক্টোবর মধ্যরাতে বাড্ডায় মা আরজিনা হত্যা করে ৯ বছরের শিশু নুসরাতকে। নুসরাত হত্যার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে কাকরাইলে আলমগীর কবিরের নির্দেশে হত্যা করা হয় তার স্ত্রী শামসুন্নাহরকে। আর মা হত্যার দৃশ্য দেখে ফেলায় নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় ছেলে শাওনকে। হত্যার পিছনে অবৈধ সম্পর্ক ও পারিবারিক কলহ। এছাড়াও গত বছর রাজধানীর বনশ্রীতে মাহফুজা নামের এক মা তার ১২ বছর বয়সী অরনী ও ৭বছর বয়সী আলভীকে হত্যা করে। পরকীয়া দেখে ফেলায় গত ২৭ অক্টোবর নরসিংদীতে চাচী তমুজা বেগম হাত পা বেঁধে সারাশরীরে কেরোসিন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করে ১৩ বছরের কিশোরী আজিজাকে। ফরিদপুরে মোটর সাইকেল কিনে না দেয়ায় বাবাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে কিশোর মুগ্ধ। গতমাসে চুয়াডাঙ্গায় স্ত্রীর সাথে পরকীয়ায় জড়িয়ে পাড়ায় মাছ ব্যবসায়ী রিপনকে হত্যা করে তার বন্ধু মাঈনুদ্দিন। গাজীপুর কালিয়াকৈর উপজেলায় বাবা জুয়েল তার পরকীয়া প্রেমিকাকে বিয়ে না করায় গুম করে হত্যা করা হয় জুয়েলের পুত্রশিশু আমিনকে। ৫ নভেম্বর নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যারয়ে ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদের জের ধরে গুরুত্বর আহত হন ৫ জন। ৩ নভেম্বর চট্টগ্রামে চলন্ত বাসে পোষাককর্মী ধর্ষণ।

একইদিনে গাজীপুরে পোশাককর্মীকে গণধর্ষণ করার মত জঘন্য ঘটনাও ঘটে। স্বামী-স্ত্রী, মা-বাবা, কিশোর-কিশোরী, পিতা-পুত্র, বন্ধু-বান্ধবী, প্রেমিক-প্রেমিকা ইত্যাদির মধ্যে সামান্য বিবেদ, বিচ্ছেদ,ঝগড়া, কলহের জের ধরেই এ সব হত্যাকান্ড। বিশেষ করে মাতা-পিতার হাতে সন্তান খুনের প্রবনতা ইদানিং ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।

এই অবক্ষয়ের মূলে রয়েছে ধর্মহীনতা, অসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব এবং সর্বগ্রাসী অশ্লীলতার মতো আরও কিছু বিষয়।

সুতরাং, নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে সন্তানদের আদর্শবান নাগরিক ও সত্যিকারের মুসলিম হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে মরণব্যাধি অবক্ষয় থেকে দেশ, জাতি, সমাজকে রক্ষা করা সম্ভব।অতএব,আমাদের সবাইকে নিজের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের চেষ্টা করতে হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়