স্বাস্থ্য অধিদফতর যেন মালেকের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান, স্ত্রী ছেলে মেয়ে ভাই ভাতিজাসহ চাকরি করে অন্তত ১৫ জন

205

অনলাইন ডেস্ক : শুধু ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমেই ড্রাইভার মালেক কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামাননি, নিজের আত্মীয়স্বজনের অনেককে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন অসদুপায়ে। বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদফতরে চাকরিরত আছেন তার স্ত্রী, দুই মেয়ে, এক ভাই, ভাতিজা ও ভায়রা।

এদের কেউ কেউ যথাযথ যোগ্যতা না থাকলেও অনায়াসে সরকারি চাকরিতে ঢুকেছেন। মালেক গ্রেফতার হওয়ার পর এসব বিষয়ে অনেকে মুখ খুলতে শুরু করেছেন।

সূত্র বলছে, মালেক ১৯৮৬ সালে স্বাস্থ্য অধিদফতরে চাকরি পান। ৩৪ বছর ধরে তিনি স্বাস্থ্য অধিদফতরে চাকরি করছেন। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি নিজের পরিবারের সদস্য এবং আত্মীয়স্বজন মিলিয়ে অন্তত ৩০ জনকে চাকরি পাইয়ে দেন। চাকরিতে ঢোকার ৫ বছরের মাথায় তিনি ছোট ভাই খালেককে স্বাস্থ্য অধিদফতরে ঢোকাতে সফল হন। এরপর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে সুবিধাভোগী পদস্থ কর্মকর্তাদের সহায়তায় তিনি তার কর্মস্থলকে রীতিমতো পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে সক্ষম হন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মালেকের আত্মীয়স্বজনের প্রায় সবাই তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। তবে প্রভাবশালী চালকের আত্মীয় বলে কথা। ফলে তারাও স্বাস্থ্য অধিদফতরে ক্ষমতাধর হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদফতরে কর্মরত আছেন তার মেয়ে নওরিন সুলতানা (কম্পিউটার অপারেটর), ভাই আবদুল খালেক (অফিস সহায়ক), ভাতিজা আবদুল হাকিম (অফিস সহায়ক), আত্মীয় কামাল পাশা (অফিস সহায়ক), ভায়রা মাহবুব হোসেন (গাড়িচালক), ভাগনে সোহেল শিকারি (গাড়িচালক) এবং বড় মেয়ের স্বামী রতন অধিদফতরে ক্যান্টিন ম্যানেজার হিসেবে চাকরি করছেন। মালেকের দুই মেয়ে অফিস সহায়ক পদে চাকরি পেলেও অফিসে দায়িত্ব পালন করছেন সহকারী পদে।

প্রসঙ্গত, স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোটিপতি গাড়িচালক আবদুল মালেক ওরফে হাজী মালেক অস্ত্র ও জাল টাকাসহ র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হন। এখন তাকে ১৪ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তার কাছ থেকে সহযোগীদের সম্পর্কে ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক সারোয়ার বিন কাশেম যুগান্তরকে বলেন, মালেকের মতো অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে র‌্যাবের গোয়েন্দা অনুসন্ধান চলছে। অপরাধ করলে কেউ পার পাবে না।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ড্রাইভার মালেকের সঙ্গে যাদের সখ্য আছে, তারা চাকরিবিধির ছিটেফোঁটাও মানতে রাজি নন। মালেকের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত কর্মচারীদের কেউ কেউ বছরের ৬ মাসও ঠিকমতো অফিস করেন না। এমনকি প্রাধিকার না থাকলেও মালেকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীও গাড়ি বরাদ্দ পেয়েছেন। সরকারি বাসা বরাদ্দ নিয়ে ভাড়া দিয়ে রেখেছেন অন্য লোকের কাছে। ক্ষমতার দাপটে মালেকের ঘনিষ্ঠভাজনরা স্বাস্থ্য অধিদফতরে চাকরি করছেন বছরের পর বছর। তাদের অন্য কোথাও বদলি করা হয় না।

সূত্র জানায়, মালেকের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত অধিদফতরের উচ্চমান সহকারী নাসরিন আক্তার একই চেয়ারে বসছেন ১৭ বছর ধরে। দীর্ঘ এই সময়কালে একবারের জন্য তার অন্যত্র বদলির আদেশ হয়নি। নাসরিন ২০০৪ সালে মালেকের মাধ্যমেই স্বাস্থ্য অধিদফতরের চাকরি পান। অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক মিজানুর রহমানের সঙ্গে মালেকের সখ্য ছিল ওপেন সিক্রেট। মূলত ওই সময়েই মালেকের ঘনিষ্ঠ অনেকেই চাকরি পান।

অধিদফতরের একজন সহকারী পরিচালক যুগান্তরকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরে কোনো নিয়োগ শুরু হলেই মালেক ড্রাইভার সক্রিয় হয়ে ওঠেন। কারণ বড় বড় কর্মকর্তা আড়ালে থেকে মালেকের ঘাড়ে বন্দুক রেখে নিয়োগ বাণিজ্য করেন। যেমন- ২০০৮ সালে দেড় হাজার স্বাস্থ্য সহকারী নিয়োগ করা হয়। এর মধ্যে অন্তত ৭৫০ জনের চাকরি হয় মালেকের মাধ্যমে।

এছাড়া ৫ হাজার মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টের মধ্যে আড়াই হাজার জনই মালেকের রিক্রুট বলে ধরা হয়। ২০১০ সালে স্বাস্থ্য অধিদফতরে একটি বড় নিয়োগ হয়। কমিউনিটি ক্লিনিকে সিএইচসিপি পদে প্রায় ১০ হাজার লোক নিয়োগ করা হয়। এই নিয়োগ থেকে মালেক বড় অঙ্কের ঘুষ বাণিজ্য করেন। অনেকে বলেন, প্রায় ৫ হাজার প্রার্থী নিয়োগ করা হয় মালেকের মাধ্যমে।

সূত্র বলছে, শুধু বড় নিয়োগ নয়, বছরজুড়েই স্বাস্থ্য অধিদফতরে অফিস সহকারী, স্টোরকিপার, গাড়িচালকসহ নানা ধরনের নিয়োগ লেগেই থাকে। প্রায় সব নিয়োগে মালেকের লোককে চাকরি দিতে হয়। না হলে অধিদফতরের কর্তাব্যক্তিদের রাতারাতি অন্যত্র পোস্টিং হয়ে যায়।

মন্ত্রণালয়েও মালেকের আধিপত্যের কারণে অধিদফতরের মহাপরিচালকদের অনেকেই তাকে সমীহ করে চলেন। এমনকি সাবেক মহাপরিচালকদের কেউ কেউ একধাপ এগিয়ে মালেকের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। একাধিক মহাপরিচালক তাকে নিয়ে এক টেবিলে বসে দুপুরের খাবারও খান।

সূত্র জানায়, মালেকের ভাগনে সোহেল ওরফে সোহেল শিকারি অধিদফতরের ক্ষমতাধর ড্রাইভারদের মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে উপপরিচালক প্রশাসনের গাড়ি চালান সোহেল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়। একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সোহেলের হাতে লাঞ্ছিত হন।

এছাড়া মালেকের ভায়রা অধিদফতরের অফিস সহায়ক ছিলেন। কিন্তু বেআইনিভাবে তাকে পদোন্নতি দিয়ে গাড়িচালক পদে বসানো হয়। তবে তিনি একদিনও গাড়ি নিয়ে বের হননি। বর্তমানে তার পোস্টিং অধিদফতরের এনসিডিসি শাখায়।

ক্ষমতার দাপটে মালেকের নিজস্ব লোক হিসেবে পরিচিত অধিদফতরের বেশ কয়েকজন গাড়িচালক অঢেল অর্থসম্পদের মালিক। এদের মধ্যে অন্যতম শাহজাহান ড্রাইভার। বর্তমানে তিনি পরিচালক (অর্থ)-এর গাড়ি চালান। শাহজাহানের ছেলে-মেয়েরাও অধিদফতরে বিভিন্ন পদে চাকরি করছেন। এক ছেলে ইপিআই শাখায় আছেন সুপারেনটেন্ড পদে।

গাড়িচালক মাইনুল হোসেনও মালেকের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত। তার বাড়ি কিশোরগঞ্জ হলেও বর্তমানে তিনি গাজীপুরের স্থায়ী বাসিন্দা। র‌্যাভ-ফোর ব্র্যান্ডের নিজস্ব পাজেরোতে চড়ে তিনি অফিসে আসেন। গাজীপুরে তার গাড়ি কেনাবেচার ব্যবসাও আছে। রেন্ট-এ-কারে তার একাধিক হাইয়েস মাইক্রো ও প্রাইভেট কার চলাচল করে।

অধিদফতরের মেডিকেল এডুকেশন শাখার অতিরিক্ত মহাপরিচালকের গাড়িচালক রফিকুল ইসলাম ওরফে জামাল অধিদফতরে দাপুটে ড্রাইভার হিসেবে পরিচিত। কারণ তিনি মালেকের ঘনিষ্ঠভাজন। গাড়িচালক থেকে সম্প্রতি তিনি ব্যবসায়ীর খাতায়ও নাম লিখিয়েছেন।

গাজীপুরের বোর্ডবাজারে জুতার কারখানা আছে তার। কিশোরগঞ্জের বাসিন্দা হলেও জামাল এখন গাজীপুরে স্থায়ীভাবে আবাস গড়েছেন। জমি কিনে ৫তলা বাড়িও করেছেন।

অধিদফতরের হিসাবরক্ষক আবদুল মতিন মালেক ড্রাইভারের পরিচয়ে ক্ষমতার ছড়ি ঘোরান বলে অনেকের অভিযোগ। তাকে টাকার কুমির বলা হয়। কারণ বিভিন্ন ট্রেনিং প্রোগ্রামের অর্থ হাতিয়ে নিয়ে অঢেল বিত্তবৈভব গড়েছেন মতিন। অঢেল টাকায় উত্তরা আবাসিক এলাকার জসীমউদ্দীন রোডে নির্মাণ করেছেন ৬তলা বিলাসবহুল বাড়ি। এছাড়া রাজশাহী শহরে কিনেছেন একাধিক প্লট ও ফ্ল্যাট। তার বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়।