করোনা মোকাবেলার যথেষ্ট সক্ষমতা আমাদের রয়েছে * পুরুষদেরও ধর্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে * প্রতিটি ক্ষেত্রে সুযোগ করে দিচ্ছি, যাতে নারী এগিয়ে যেতে পারে
বাসস,৯ মার্চ ২০২০,ঢাকা : করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নির্দেশনা মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী এখন চলছে করোনাভাইরাস, এই ভাইরাসের কারণে অনেক দেশ এখন অর্থনৈতিকভাবেও সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। আমরা কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করছি। কোথাও যদি কোনো সমস্যা দেখা দেয়, যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছি। ইনশাআল্লাহ এই ধরনের সমস্যা মোকাবেলার যথেষ্ট সক্ষমতা আমাদের রয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী রোববার সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।
করোনাভাইরাস মোকাবেলায় দেশবাসীর প্রতি তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষার নির্দেশনাগুলো আমি সকলকে মেনে চলার অনুরোধ জানাচ্ছি। এই ক্ষেত্রে আমি বলব সবাইকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে। এছাড়া কীভাবে চলতে হবে, কীভাবে কাজ করতে হবে সেজন্য প্রতিদিনই আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে।’
মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। ইউএন উইমেনের এ দেশীয় প্রতিনিধি ও ভারপ্রাপ্ত আবাসিক সমন্বয়ক শোকো ইশিকাওয়া অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন।
মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী রওশন আক্তার স্বাগত বক্তৃতা করেন। ‘প্রজন্ম হোক সমতার, সকল নারীর অধিকার’ প্রতিপাদ্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ‘জয়িতা পদকে’ ভূষিত সফল পাঁচ নারীর হাতে সম্মাননা তুলে দেন।
এরা হলেন আনোয়ারা বেগম, ডা. সুপর্ণা দে সিম্পু, মরহুম মমতাজ বেগম, অরনিকা মেহেরিন ঋতু ও সিআরপির প্রতিষ্ঠাতা ভ্যালেরি অ্যান টেইলর। অনুষ্ঠানে ‘বঙ্গবন্ধু ও নারী উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রামাণ্যচিত্র পরিবেশিত হয়। পরে অনুষ্ঠিত মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও উপভোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছি, যাতে তারা এগিয়ে যেতে পারে। কাজেই তারা যেখানেই যাচ্ছে তাদের দক্ষতা দেখাচ্ছেন। আমাদের মেয়েরা ভারোত্তোলন থেকে শুরু করে এভারেস্ট পর্যন্ত বিজয় করে ফেলেছে। খেলাধুলায় আমাদের যেসব মেয়ে ভালো করছে তাদেরকে আমরা উৎসাহ দিচ্ছি এবং সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে যাচ্ছি। মেয়েরা যে পারে সেটা আজ প্রমাণিত।’
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের হাইকোর্ট এবং সুপ্রিমকোর্টে বিচারপতি পদে কখনও কোনো মেয়েরা পদোন্নতি পায়নি। তবে প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পরই সে সময়কার রাষ্ট্রপতিকে বলেছিলাম, এখানে মহিলা বিচারপতি নিয়োগ দিতে হবে এবং সেই থেকেই শুরু আর এখন অনেক মহিলা বিচারপতি আছেন।
সরকারপ্রধান বলেন, ‘শান্তিরক্ষা মিশনে আমাদের পুলিশ বাহিনীর যে কন্টিনজেন্ট কঙ্গোতে আছে, সেখানে তারা খুব ভালো করছে এবং শান্তিরক্ষা মিশনে মেয়েদের গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে। সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর নারী অফিসারদেরকেই তারা চাচ্ছে। কারণ মেয়েরা সেখানে অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছে। এজন্য আমি সত্যিকারেই গর্বিত।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘নারীরা যত শিক্ষিত হবে, নারীরা যত স্বাবলম্বী হবে সমাজ তত দ্রুত এগিয়ে যেতে পারবে। কারণ সমাজের অর্ধেক অংশকে অকেজো রেখে দিয়ে একটি সমাজ সঠিকভাবে চলতে পারে না। সে সমাজ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলবে।’
তিনি বলেন, ‘ক্ষমতা জোর করে হয় না। ক্ষমতা নিজের যোগ্যতায় অর্জন করে নিতে হয়। ক্ষমতা কেউ হাতে তুলে দেয় না। সেভাবেই আমাদের বোনদের নিজেদের তৈরি করতে হবে।’
সরকারপ্রধান বলেন, ইদানীং নারী ধর্ষণের বিষয়টি কেবল বাংলাদেশে নয়, বিশ্বজুড়েই একটি সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। আমি মনে করি এখানেও আমাদের একদিকে যেমন সচেতনতা দরকার তেমনি পুরুষ শ্রেণি যারা, তাদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে। পুরুষ সমাজের পক্ষ থেকেও ধর্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।’
নারীদের পাশবিক নির্যাতনকারীরা সমাজে সবচেয়ে ঘৃণিত এবং পশুর চেয়েও অধম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এদের বিরুদ্ধে আমাদের পুরুষ সমাজকেও ব্যবস্থা নিতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা দেখেছি এই বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন গণহত্যা চালিয়েছে সেই সময় মেয়েদের ওপর কী রকম পাশবিক অত্যাচার করেছিল। জাতির পিতা এই নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধিতে ভূষিত করে তাদের সমাজে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেন। নারী পুনর্বাসন বোর্ড গঠন করেন। বিদেশ থেকে চিকিৎসক এনে চিকিৎসা করান। যে সব মেয়ের বিয়ে হচ্ছিল না, তাদের নিজের পরিচয়ে বিয়ের উদ্যোগ নেন।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, জাতির পিতা বলেছিলেন- ‘লিখে দাও বাবার নাম শেখ মুজিবুর রহমান, ঠিকানা ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘জাতির পিতা বলতেন- শুধু মেয়েদের অধিকারের কথা বললে হবে না, তাদের অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। বঙ্গবন্ধু সেটাই করেছিলেন।’ তার মা’ ‘বঙ্গমাতা’ (শেখ ফজিলাতুননেছা) অনেককে নিজের গহনা পর্যন্ত দিয়ে বিয়ের উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলেও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনকালে বঙ্গমাতার অবদানকে স্মরণ করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।
আওয়ামী লীগের সভাপতি বলেন, ‘আমাদের দেশে একমাত্র সংগঠন আমাদের আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে নারীদের অধিকারের কথা রয়েছে। আমাদের ঘোষণাপত্রেও সমান অধিকারের কথা বলা আছে।’
‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১ প্রণয়ন, ‘নারী উন্নয়নে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০১৩-২৫’, ‘পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) বিধিমালা ২০১৩’, ‘ডিএনএ আইন’, ‘যৌতুক নিরোধ আইন’, ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন’ ও ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ বিধিমালা’ প্রণয়ন ছাড়াও তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তার সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সারা বিশ্বে জেন্ডার গ্যাপ নিয়ে একটি প্রশ্ন থাকলেও আমাদের ক্ষেত্রে সমস্যাটা উল্টে গেছে। কারণ আমাদের এখন মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে, ছাত্রের সংখ্যা কমেছে। পাসও ছাত্রীরাই বেশি করছে এবং ফলাফলও তারা ভালো করছে।’
ছেলেরা কেন পিছিয়ে আছে সেজন্য জেন্ডার গ্যাপ পূরণে তাকে এখন নজর দিতে হবে এবং এজন্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত শিক্ষামন্ত্রীকে এ বিষয়টিতে নজর দেয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
তার সরকার মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাসে উন্নীত করেছে এবং মাতৃত্বকালীন ভাতা, ল্যাকটেটিং মাদার ভাতা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা এবং স্বামী পরিত্যক্ত ভাতা দিয়ে যাচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন।
অ্যাসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তার সরকারের কঠোর আইন প্রণয়ন এবং মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সাজা প্রদানের উদ্যোগ তুলে ধরে অ্যাসিড সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে তার সরকারের সাফল্যেরও উল্লেখ করেন সরকারপ্রধান।
বিশ্বব্যাপী ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পর জাতির পিতার নির্দেশে ১৯৭৩ সাল থেকে বাংলাদেশে দিবসটি পালন করা হচ্ছে।