যেভাবে জন্ম হয় বিশ্বের একমাত্র অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েলের

13

ইসরায়েল। এটি এখন শুধু কোনো গোষ্ঠীর নাম নয়। একটি রাষ্ট্র, একটি মতাদর্শ। রাষ্ট্র হিসেবে এটি অবৈধ আর এর মতাদর্শ হলো বর্ণবাদী ইহুদিবাদ। মুসলিমদের এক সময়ের কিবলা পবিত্র আল-আকসা মসজিদ দখল করে এই রাষ্ট্রের জন্ম। ধূর্ততা, প্রতারণা আর নৃশংসতার মধ্য দিয়েই এই রাষ্ট্রটির সৃষ্টি।

israeli occupation palestine

নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাসের দোহাই দিয়ে ফিলিস্তিনে ফিরতে চাইতো সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইহুদীরা। তারা মনে করলো- আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থায় তাদের একটি রাষ্ট্র থাকা চাই। তাদের এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা থিউডর হারজেল।

উসমানী খিলাফাতের শেষ দিকের সুলতান ছিলেন সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ। ইহুদীবাদী নেতা হারজেল একটি ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে সুলতান আবদুল হামিদের কাছে ফিলিস্তিনে ভূ-খণ্ড ক্রয় করার প্রস্তাব করেন। বিনিময়ে ১৫০ মিলিয়ন পাউন্ড দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন যা ছিল তৎকালীন হিসাবে বিপুল পরিমাণ।

কিন্তু সুলতান আবদুল হামিদ হারজেলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন ‘ফিলিস্তিন আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, এটি সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সম্পত্তি। ফিলিস্তিন রক্ষার্থে যে উম্মাহ নিজেদের রক্ত অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছে এটা তাদের সম্পত্তি। তোমাদের অর্থ তোমাদের কাছেই রাখো।’

কিন্তু ইহুদীরা থেমে থাকেনি। তারা গোপনে ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে অল্প অল্প করে বিচ্ছিন্নভাবে জমি কিনতে থাকে। ব্যবসার আড়ালে সেখানে জড়ো হতে থাকে। এর মধ্যেই ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে তুরস্কের সেনাদের হাত থেকে জেরুজালেম দখল করে নেয় ক্রুসেডার ব্রিটেন। তাদের সর্বোতভাবে সহযোগিতা করে ইহুদীরা।

তখন ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে, ফিলিস্তিনের মাটিতে ইহুদীদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠন করবে। ১৯০৫ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা ছিল মাত্র কয়েক হাজার। কিন্তু ১৯১৪ সাল থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশদের সহযোগিতায় ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা ২০ হাজারে উন্নীত হয়।

ব্রিটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার জেমস বেলফোর ইহুদী রাষ্ট্র গঠনের বিষয়টি জানিয়ে চিঠি লিখেন ইহুদি আন্দোলনের নেতা ব্যারন রটসচাইল্ডকে। তৎকালীন ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সে চিঠি কুখ্যাত ‘বেলফোর ডিক্লারেশন’ হিসেবে পরিচিত।

ইউরোপে ইহুদীদের প্রতি যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সেটি তাদের একটি নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনের ভাবনাকে আরও তরান্বিত করে। ১৯৩৩ সালের পর থেকে জার্মানির শাসক অ্যাডলফ হিটলার ইহুদীদের প্রতি কঠোর হতে শুরু করেন। ইতোমধ্যে জাহাজে করে হাজার হাজার ইহুদী অভিবাসী ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডে আসতে থাকে।

তখন ফিলিস্তিনী আরবরা বুঝতে পারে যে তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে। ফিলিস্তিনী আরবরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য বিদ্রোহ করে। কিন্তু আরবদের সে বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করে ক্রুসেডার ব্রিটিশ সৈন্যরা।

ইহুদীরা তাদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনে বদ্ধপরিকর ছিল। ব্রিটেনের সহায়তায় সে অনুযায়ী তারা কাজ এগিয়ে নিচ্ছিল। তখন ৩২ হাজার ইহুদি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়।

যেখানে ১৯৩১ সালে ইহুদীদের এই সংখ্যা প্রায় পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১ লাখ ৮০ হাজারে পৌঁছায়। এভাবে ফিলিস্তিনে ইহুদী অভিবাসীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে থাকে এবং ১৯৪৮ সালে সেখানে ইহুদীদের সংখ্যা ৬ লাখে উন্নীত হয়।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্রিটেন বিষয়টিকে জাতিসংঘে নিয়ে যায়। ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে দুটি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ। একটি ইহুদিদের জন্য এবং অন্যটি আরবদের জন্য। ইহুদিরা মোট ভূখণ্ডের ১০ শতাংশের মালিক হলেও তাদের দেয়া হয় মোট জমির ৫৫ ভাগ।

কিন্তু আরবদের জনসংখ্যা এবং জমির মালিকানা ছিল ইহুদীদের দ্বিগুণ। স্বভাবতই আরবরা এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। তারা জাতিসংঘের এ সিদ্ধান্ত খারিজ করে দেয়। কিন্তু ফিলিস্তিনীদের ভূখণ্ডে তখন ইহুদীরা বিজয় উল্লাস শুরু করে। এভাবেই অবৈধ ইসরায়েল রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়।

এরপর ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যায় ব্রিটেন। একই দিন তৎকালীন ইহুদী নেতারা ঘোষণা করেন রাতেই ইহুদী রাষ্ট্রের জন্ম হবে এবং তাই ঘটে। মুহূর্তেই যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেন।

আরবরা অনুধাবন করেছিল যে কূটনীতি দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না। ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যেই আরবরা আক্রমণ শুরু করে। একসাথে পাঁচটি আরব দেশ ইসরায়েলকে আক্রমণ করে। তারা হচ্ছে – মিশর, ইরাক, লেবানন, জর্ডান এবং সিরিয়া। তাদের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ত্রিশ হাজারের মতো।

অন্য দিকে ইসরায়েলের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৫ হাজার। কিন্তু আরব দেশগুলোর মধ্যে কোন সমন্বয় ছিল না। তা ছাড়া আরব নেতৃত্ব একে অপরকে বিশ্বাস করতো না। এরপরও জেরুজালেম দখলের জন্য আরব এবং ইসরায়েলের মধ্যে চলছে তীব্র লড়াই।

তীব্র লড়াইয়ের এক পর্যায়ে ইসরায়েলি বাহিনী পিছু হটতে থাকে। তাদের অস্ত্রের মজুত শেষ হয়ে যায়। সম্ভাব্য পরাজয় আঁচ করতে পেরে ইহুদিরা নিজেদের শক্তি সঞ্চয়ের জন্য সময় নেয়। আর কিছুদূর অগ্রসর হলেই মিশরীয় বাহিনী তেল আবিবের দিকে অগ্রসর হতে পারতো। তখন জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।

যুদ্ধবিরতির সময় শক্তি সঞ্চয় করে ইসরায়েল। তখন চেকোস্লোভাকিয়ার কাছ থেকে আধুনিক অস্ত্রের চালান আসে ইসরায়েলের হাতে। নতুন করে আরবদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ইসরায়েলি বাহিনী। এ যুদ্ধে পরাজিত হয় আরবরা আর অবৈধ ইসরায়েল রাষ্ট্রের বয়স বাড়তে থাকে।

এরপর ১৯৫৬, ১৯৬৭, ১৯৭৩ এবং ১৯৮২ সালেও অবৈধ ইসরায়েলি রাষ্ট্রটির সঙ্গে যুদ্ধ করে আরবরা। কিন্তু প্রত্যেকবারই তারা পরাজিত হয়। এর কারণ, যুদ্ধের প্রস্তুতি আগেই জেনে যেতো ইসরায়েল, অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রের পিছিয়ে পড়া আরবরা ছিল লক্ষ্যহীন। এ ছাড়া যুদ্ধ শুরু হলেই ইসরায়েলের হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তো পশ্চিমা ক্রুসেডাররা।