অনলাইন ডেস্ক: স্থাপত্য শিল্প মুসলমানদের আবিষ্কার না হলেও মুসলিম সভ্যতায় এ শিল্পের ব্যাপক সমৃদ্ধি এবং উন্নতি ঘটেছে। তাঁবু থেকে শুরু করে প্রাসাদ পর্যন্ত মুসলিম স্থাপত্যবিদরা সবকিছুতেই রেখেছেন সৃজনশীলতার স্বাক্ষর। একটি বাড়ি কেবল বাড়িই নয়, বরং সংস্কৃতির বাহক, রুচির পরিচায়ক। ঘরবাড়ি দেখেই বোঝা যায় একটি জাতির অর্থনৈতিক অবস্থার খতিয়ান। মেপে নেওয়া যায় জীবনাচারের ধরন।
ইসলাম যখন এলো, আরবের গ্রামাঞ্চলের সিংহভাগ ঘরই ছিল তাঁবু। তাঁবুগুলো তৈরি হতো চামড়া দিয়ে। ঐতিহাসিক মাকরিজি ‘আল খুতাত ওয়াল আসার’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আরবে জাহেলি যুগে তাঁবুই প্রচলিত ছিল। ইসলাম আসার পর তারা যখন শহরে বসবাস করতে লাগল, তখন ঘরবাড়িও বানাতে শুরু করল।’
আরবের উত্তরাঞ্চল, বিশেষ করে মক্কা এবং তার উত্তর ও পূর্বে ছোট ছোট ঘর বানানো হতো। মদিনায় হিজরত করার পর রাসূল (সা.) মসজিদে নববী লাগোয়া ছোট ছোট ঘর বানিয়েছিলেন। ঘর বানাতে ব্যবহৃত হয়েছিল কাঁচা ইট এবং খেজুরের ডাল। ইবনে খালদুন ‘আল মুকাদ্দিমা’তে বলেন, ‘রাসূল (সা.)-এর এ ঘরই ছিল ইসলামি সভ্যতার প্রথম স্থাপনা।’
ঘরের পরিমাপ কতটুকু হবে এর পেছনে কাজ করত অর্থনৈতিক চিন্তা এবং পরিবারের সদস্য সংখ্যা। ইবনে খালদুনের মতে, ধনী-দরিদ্রের ঘরে ফারাক হতো। ধনী বানাত ভবন। তাতে থাকত অনেক কামরা। আর যারা দুর্বল, তারা বানাত ছোট ছোট ঘর। কখনো রাজনৈতিক কারণও ভূমিকা রাখত ঘরের পেছনে। কোনো রাষ্ট্রপ্রধান শহর নির্মাণ করলে তিনি বলে দিতেন, এ শহরের ঘরবাড়ি কেমন হবে। যেন তার শহর সর্বোৎকৃষ্ট হয়।
১৭ হিজরিতে কুফা শহরের যখন গোড়াপত্তন হয়, লোকজন তাদের ঘর বানিয়েছিল বাঁশ দিয়ে। কিছুদিন পর ৮০টি ঘর পুড়ে যায়। তখন তারা খলিফা ওমর (রা.)-এর কাছে পাকা ঘর তোলার অনুমতি চায়। খলিফা তাদের অনুমতি দেন। সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) আবু হিয়াজকে নির্দেশ দিলেন ঘরবাড়ি বানানোর ব্যবস্থা করার জন্য। বলে দিলেন, ঘরবাড়ি এমনভাবে বানাতে হবে, যেন প্রধান সড়কের জন্য ৪০ হাত জায়গা ছেড়ে দেওয়া হয়। উপপ্রধান সড়কগুলোর জন্য ৩০ ও ২০ হাত রাখা হয়। গলিপথের জন্য ছাড়তে হবে ৭ হাত করে (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)।
মুসলিম সভ্যতায় ঘর বানানোর ক্ষেত্রে সুন্দর একটা অবকাঠামো দেখা যায়। প্রথমেই থাকত দহলিজ। বাড়ির দরজা থেকে ঘরের অভ্যন্তরে ঢোকার আগ পর্যন্ত বিস্তৃত। রাসূলের যুগেও এমন ছিল। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আমি শিশুদের সঙ্গে খেলছিলাম। এমন সময় রাসূল (সা.) এলেন। আমি দহলিজে ঘরের দরজার পেছনে লুকিয়ে গেলাম।’
‘আল ফারাজ বাদাশ শিদ্দাত’ গ্রন্থে তানুখি বলেন, দহলিজ ব্যবহার হতো মেহমানদের অভ্যর্থনায় এবং তাদের আপ্যায়নে। কখনো দহলিজ থেকেই ওপর তলায় উঠার সিঁড়ি থাকত। দহলিজ পেরিয়ে ঘরে ঢুকলে দেখা যেত একটা ফ্লোর। এর বিভিন্ন দিকে চলে গেছে বিভিন্ন কামরা। এ ফ্লোরকে মজলিস কক্ষও বলা যায়। এখানে মেহমানরা বসে আড্ডা দিত, খাবার খেত। তানুখি বলেন, একটি বাড়িতে একাধিক মজলিস কক্ষও থাকত।
বাড়িতে থাকত আলাদা শয়নকক্ষ। আসমাঈ বলেন, ‘একদিন খলিফা মামুনের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চাইলাম। তিনি অনুমতি দিলেন। আমি অন্দরমহলে ঢুকে দেখি, তিনি তার শয়নকক্ষে শুয়ে আছেন।’ যারা ছিল বইপ্রেমী, তাদের বাড়িতে একটা লাইব্রেরি কক্ষও থাকত। আবু উসমান নিশাপুরি সাবুনি বলেন, আমি অজু ছাড়া কখনো লাইব্রেরি কক্ষে ঢুকিনি। (ইবনে আসাকির) ঘরের ছাদ বানানো হতো গাছের শক্ত ডাল দিয়ে। কখনো ছাদেও একটি কামরা থাকত। ছাদের ঘরে যাওয়ার জন্য নির্মাণ করা হতো সিঁড়ি।
মুসলিম সভ্যতায় বানানো ঘরগুলোর মধ্যে একাধিক দরজা দেখা যায়। সাহাবি ইয়ালা ইবনে মুনয়া তামিমি (রা.)-এর ঘরে দুটি দরজা ছিল। তানুখি বলেন, কখনো কখনো নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে লোহার দরজা লাগানো হতো। কারও কারও ঘরে এমন কিছু দরজা থাকত, প্রতিবেশীরাও সে দরজার কথা জানত না। বাগদাদের আমির আবু জাফর শিরযাদ বলেন, আমার ঘরে চৌদ্দটি দরজা চৌদ্দটি পথ ও গলির দিকে। এর মধ্যে কয়েকটির খবর প্রতিবেশীরাও জানে না। নিরাপত্তার জন্য দরজায় ঝুলানো হতো তালা।
বাড়ির পানি সমস্যা নিরসনের জন্য কূপ খনন করা হতো। মুআবিয়া (রা.)-এর বাড়িতে কূপ ছিল। আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.) তার একটি বাড়িতে নিজেই কূপ খনন করেছিলেন। এ ছাড়া বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখার জন্য হাউজ খনন করা থাকত। পর্যটক ইবনে হাওকাল লিবিয়ায় এবং ফরাসি পর্যটক নাসির খসরু ফিলিস্তিনে এমন হাউজের কথা উল্লেখ করেছেন।
বাড়ি মানে আপন ঠিকানা। অত চাকচিক্য না থাকলেও মুসলিম সভ্যতায় ঘরবাড়িগুলো ছিল পরিপাটি। তবে উমাইয়া যুগে শুরু হয় ঘরের সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ। তখন মক্কায় মুআবিয়া (রা.) একটি ঘর বানিয়েছিলেন। তাতে প্লাস্টার করে নকশাও তুলেছিলেন। এর চেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ অলঙ্করণ করেছিলেন বাদশা হারুনুর রশীদ। বাড়ির বাইরে তিনি ব্যবহার করেছিলেন মার্বেল এবং মোজাইক। ভেতরে ব্যবহার করেছিলেন কাচের জিনিস।