মুক্ত গণমাধ্যম দিবস: কেন পেছনে হাঁটছে বাংলাদেশ?

47

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাবিষয়ক বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের আরও একধাপ অবনতি হয়েছে। সম্প্রতি প্যারিসভিত্তিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার (আরএসএফ) বার্ষিক এই সূচক প্রকাশ করেছে। আরএসএফ-এর সূচকে থাকা ১৮০টি দেশের মধ্যে এখন বাংলাদেশের অবস্থান ১৫১তম। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫০ তম।

গণমাধ্যমের এই বুমের মধ্যে স্বাধীনতা সূচকে কেন পেছনে হাঁটছে বাংলাদেশ? সাংবাদিকতার শিক্ষক, সাংবাদিক নেতা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা বলছেন, কেবল সুষ্ঠু গণতন্ত্রই প্রেস ফ্রিডম নিশ্চিত করতে পারে। আর মুক্ত সাংবাদিকতার জন্য দরকার সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি করার সক্ষমতা। যে পথে এখনও সফল হয়নি বাংলাদেশ।

প্রায় ১১ বছর আগে, ২০০৯ সালে বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২৩ নম্বরে। অর্থাৎ এই ১১ বছরে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশ ২৮ ধাপ পিছিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সবার পেছনে। বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যম স্বাধীনতা সূচক ২০২০ এ শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে নরওয়ে। শীর্ষ পাঁচ দেশের সবগুলোই ইউরোপের। তালিকার সর্বশেষ দেশ উত্তর কোরিয়া। এদিকে এই সংগঠনের হিসেব বলছে, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই ২২ বছরে বাংলাদেশে ৩৫ জন সাংবাদিকে হত্যা করা হয়েছে। ২০১৯ এর ‘সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারহীনতা’ আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে সংস্থাটির বাংলাদেশ শাখা এ তথ্য জানায়।

র‌্যাংকিংয়ে এই পিছিয়ে পড়ার কারণ বলতে গিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক গাজী টেলিভিশন (জিটিভি), সারাবাংলা ডটনেট ও দৈনিক সারাবাংলার (প্রকাশিতব্য) এডিটর-ইন চিফ সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমাদের মধ্যে স্বাধীনতার চর্চা কম এবং গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠান তার কাজ ঠিকমতো করছে না। আর করছে না বলেই মুক্ত সাংবাদিকতার ওপর সেই চাপটি এসে পড়ে। তিনি বলেন, সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব নেই, সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান তৈরির চেষ্টা নেই, সাংবাদিকদের মধ্যে এটা গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা নেই। কিন্তু এটা কখনও ভাবা ঠিক নয় যে, লড়াইটা গণমাধ্যমকর্মীর একার। এটা সমাজেরও লড়াই। সমাজের এই দুই গোষ্ঠী কেন একসঙ্গে হতে পারলো না সেটা নিয়ে ভাববার আছে। তিনি আরও বলেন, আমরা পারছি না কারণ সংসদ কাজ করছে না, আমলাতন্ত্র এখানে বিবর্তনমূলক। এটা একার লড়াই না। প্রেসফিডম ১৬ কোটি মানুষের বাক স্বাধীনতার লড়াই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়াত ফেরদৌস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমাদের পিছিয়ে পড়ার কারণ এখানে স্বচ্ছ গণতন্ত্র ব্যবস্থা নেই নেই। যেকোনও সংকটকালীন সময়ে তথ্যের অবাধ আদান-প্রদান থাকতে হবে। কিন্তু এই করোনা পরিস্থিতির মধ্যে আমরা তথ্য লুকানোর মতো ঘটনা দেখতে পাচ্ছি। ত্রাণের বিষয়ে রিপোর্ট করার অভিযোগে একাধিক মামলা হয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। করোনা পরবর্তী সময়ে আরও কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠবে রাষ্ট্র। সেই শঙ্কা থাকছে। ফলে খুব শিগগিরই আমরা র‌্যাংকিংয়ে এগুতে পারবো বলে আমার মনে হয় না।

সিনিয়র সাংবাদিক ও চ্যানেল আইয়ের সম্পাদক (অনলাইন) জাহিদ নেওয়াজ খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গণমাধ্যমের কাজ যখন সত্য উন্মোচন তখন বাস্তব কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সরকার তার বন্ধু হতে পারে না, বা সরকার চাইলেও গণমাধ্যম তার বন্ধুতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশের বেশিরভাগ গণমাধ্যম বিশেষ করে গত এক দশকে অনেকটাই সেই হাত বাড়িয়ে রেখেছে। এটা শুধু সরকারের রোষানলে পড়ার ভয় থেকে নয়, বরং গণমাধ্যমের মালিকানার যে চরিত্র-মালিকপক্ষের নানামুখী পুঁজি থেকে নানামুখী ব্যবসার আরও সম্প্রসারণ এবং তার সুরক্ষাই আসল কারণ। এর সঙ্গে সাংবাদিকদের একটি অংশও সেই সুরক্ষা দিতে নিজেদের সেভাবে গড়ে তুলেছেন। আপনি দেখবেন গণমাধ্যমের নেতৃত্ব বাছাইয়ে মালিকপক্ষ এমন কাউকে খোঁজেন যিনি সরকারের সঙ্গে সেতুবন্ধন হতে পারবেন, পেশাদারিত্ব দেখেন না। আবার সাংবাদিকরাও নিজেদের সেভাবে গড়ে তুলছেন। এটা সমস্যার একটা বড় দিক।

ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে-এর এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘ভীতি অথবা আনুকুল্য-মুক্ত সাংবাদিকতা’। এবার সাংবাদিকের সুরক্ষা, রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রভাব থেকে স্বাধীনতা আর জেন্ডার সমতার মতো সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলো প্রাধান্য পাচ্ছে।