মোঃ জাবের হোসেনঃ সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে প্রায় প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও ইয়াবা, গাজা,ফেন্সিডিল সহ নেশাজাতীয় মাদক চোরাচালানকালে পুলিশ অথবা নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ছে। এতে একদিকে যুব সমাজ ধ্বংস হচ্ছে। সেই সাথে বর্হীবিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, দেশের মাদকের বড় বড় চালান পাশ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার ও ভারত থেকে অাসছে। দেশের ৫১২ টি সীমান্ত দিয়ে মোট ৩২ প্রকার মাদক ঢুকছে। অার এর জন্য বছরে ১০ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে।
দেশে বেশি নেশা জাতীয় দ্রবগুলোর মধ্যে অাছে হিরোইন, মরফিন, আইসপিল, ভায়াগ্রা, চোলাই মদ, দেশি মদ, বিদেশি মদ, বিয়ার। তাছাড়া অারো অাছে রেক্টিফাইড স্পিরিট, কেডিন, তাড়ি, প্যাথেডিন, বুপ্রেনরফিন, টিডি জেসিক, ভাং, কোডিন ট্যাবলেট, ফার্মেন্টেড, ওয়াশ (জাওয়া), বনোজেসিক ইনজেকশন (বুপ্রেনরফিন), টেরাহাইড্রোবানাবিল, এক্সএলমুগের, সানাগ্রা, টলুইন, পটাশিয়াম পার ম্যাগানেট, মিথাইল, ইথানল ও কিটোন।
অতি সুকৌশলে ভারত থেকে দেশে অনেক দিন ধরে ফেন্সিডিল অাসছে। কাশির ঔষধ হিসাবে দীর্ঘদিন ধরে এই নেশাজাতীয় দ্রব্যটি ব্যবহৃত হয়ে অাসছে। ঔষধ হিসাবে বিক্রি করার জন্য ঔষধের দোকানে ঔষধের সাথে সারিবন্ধ ভাবে সাজিয়ে রাখে। কিন্তু দেখা যায় এর অাড়ালে মাদক হিসাবে বিক্রি হচ্ছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাদক বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। এতে করে শিক্ষার্থীরা বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।অাগামী দিনের ভবিষ্যৎ শিক্ষিত যুবকেরা। অার তারাই বেশি মাদকের প্রতি অাসক্ত হয়ে পড়ছে।
জাতিসংঘের এক রির্পোটে বলা হয়েছে বাংলাদেশের ৬৪ লক্ষ মানুষ সরাসরি মাদকাসক্তিতে অাক্রান্ত। যার মধ্যে ৮৭ ভাগই পুরুষ এবং নারীর সংখ্যা ১৩ ভাগ। সুতরাং দেখা যাচ্ছে নারীরা মাদকের প্রতি অাগের থেকে অনেক বেশি অাসক্ত হয়েছে। এই মাত্রা যদি বাড়তে থাকে অার অামরা যদি এর বিরুদ্ধো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করি তাহলে অচিরেই অামরা মারাত্নক সমস্যার সম্মুখীন হবো। জাতিসংঘের রির্পোট অনুযায়ী দেশে মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত প্রায় ১ লক্ষ মানুষ।এরা যেমন নিজের ক্ষতি করছে তেমনি নিজ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষতি করছে।
অাপরদিকে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের রির্পোটে বলা হচ্ছে দেশে ৪৬ লক্ষ মাদকাসক্তিতে অাক্রান্ত্র। যার মধ্যে ৯১ ভাগই কিশোর ও তরুণ। অার অাসক্তদের শতকার ৪৫ ভাগ বেকার এবং ৬৫ ভাগ অান্ডার গ্যাজুয়েট।সুতরাং বোঝা যাচ্ছে শিক্ষিত বেকার যুবকরা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও কাজের অবসদ থেকে মাদকের প্রতি বেশি অাসক্ত হচ্ছে।
গত ৮ বছরের ব্যবধানে দেশে প্রায় ২০ লক্ষ নতুন মাদকসেবী বেড়েছে।দেশের কিশোর সমাজের মাদকসেবী অাছে ৬৩.২৫ শতাংশ।সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে কি পরিমাণে কিশোরেরা মাদকের প্রতি অাসক্ত হয়ে পড়েছে।মাদকের প্রতি অজানা অাগ্রহ এবং মাদকের সহজলভ্যের কারণে কিশোরেরা মাদকের প্রতি বেশি অাসক্ত হয়ে পড়েছে।তাছাড়া হাত বাড়ালেই মাদক পাওয়া এবং দাম কম হওয়ায় কিশোরেরা মাদকের প্রতি অাসক্ত হচ্ছে।বিশেষ করে কিশোরেরা ইয়াবাতে বেশি অাসক্ত হচ্ছে।ইয়াবা ছাড়াও হোরোইন,ফেন্সিডিল ও গাঁজা সেবন করছে।
জাতিসংঘের এক রির্পোটে বলা হয়েছে,বাংলাদেশে বছরে ৬ হাজার কোটি টাকার ইয়াবা বিক্রি হচ্ছে।যদিও এতো পরিমাণে মাদকাসক্ত অাক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে তথাপি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উদ্যোগ খুব কম।
মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অাপারেশনস্ ও গোয়েন্দা কার্যক্রমের পরিসংখ্যান-২০১৮ অনুযায়ী ২০১০ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সকল অাইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক উদ্ধারকৃত মাদক দ্রব্যের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে অাপিয়াম উদ্ধার হয়েছে প্রায় ১২১ কেজি,হোরোইন উদ্ধার হয়েছে ১৪০০ কেজি,কোকেইন ৮. ৪৮ কেজি, ফেন্সিডিল (বোতল) ৭.০৭১.৫৮৮, ফেন্সিডিল (লিটার) ১৬.৯৭৪ এবং এটিএম (ইয়াবা ট্যাবলেট) ১০৩.১৬৫.৮৯৩ উদ্ধার হয়েছে।
শুধু মাত্র গত বছর দেশে হোরোইন উদ্ধার হয়েছে ৪০১,৬৩ কেজি, কোডিন (ফেন্সিডিল) বোতল উদ্ধার হয়েছে ৭২০৮৪৩ টি, এবং তরল উদ্ধার হয়েছে ৩৩৮ লিটার,এটিএম (ইয়াবা ট্যাবলেট) উদ্ধার হয়েছে ৪০০৭৯৪৪৩ পিচ।
এবার অাসা যাক মাদক দ্রব্যের মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে, মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক রির্পোটে বলা হয়েছে ২০১৭ সালে মোট মামলা হয়েছিলো ২৫৩৯ টি,তন্মধ্যো সাজা হয়েছে ১০১১ টি এবং খালাস পেয়েছে ১৫২৮ টি মামলা।
অপরদিকে ২০১৭ সালে অাসামীর সংখ্যা ছিলো ২৬৮০ টি,তন্মধ্যো সাজা হয়েছিলো ১০৬৫ টি এবং খালাস পেয়েছিলো ১৬১৫ টি।অার মোবাইল কোর্ট কর্তৃক অভিযানের সংখ্যা ছিলো ১২২১২ টি, মামলার সংখ্যা ছিলো ৫৯৯১ টি,তন্মধ্যো অাসামী ছিলো ৬০৪৪ টি।
দেশের মাদকাসক্তি সবচেয়ে বেশি যে কারণ গুলে সেগুলে হচ্ছে মাদকের সহজলভ্যতা,শৈশব বিকাশে সমস্যা,সঙ্গী-সাথীদের চাপে পড়ে মাদক গ্রহণ,ভালোবাসার সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ায় মানসিক কষ্ঠ থেকে মুক্তি পেতে মাদক,বাবা-মায়ের অাচারণ ও দৃষ্টিভঙ্গি গত সমস্যা,বর্তমান যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য স্মার্টনেস,মানসিক হতাশা,একাকীত্ববোধ,বিষণ্ণতা ইত্যাদি।
এসব থেকে অামরা যদি মুক্তি পেতে না পারি তাহলে ভবিষ্যতে অামার একটি সুখি ও সমৃদ্ধি দেশ অামাদের ভবিষ্যতে প্রজন্মকে উপহার দিতে পারবোনা।দেশে অারো বেশি অরাজকতা সৃষ্টি হবে।মাদকের টাকা জোগাড় করতে খুব-খারাবি হবে (ইতিমধ্যে সেটা অনেক বেড়ে গেছে)।যেহেতু মাদকাসক্তের একটা বড় অংশ যুবক ও কিশোরেরা সেহেতু অামরা যদি প্রত্যেক পরিবার থেকে নিজ নিজ স্থানে মাদকের বিরুদ্ধে এগিয়ে অাসি, সচেতন হয় তাহলে হয়তো কিছু টা কমানো সম্ভব।সেই সাথে অামাদের খেয়াল রাখতে হবে অামাদের সন্তানেরা কখন কোথায় কি করছে,কার সাথে বেড়াচ্ছে এবং প্রত্যেকটি পরিবারের উচিত সন্তানদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করা।ধোর্য্য ধরে তাদের কথা শুনতে হবে,তাদের মাঝে নিরাপত্তা সৃষ্ট করতে হবে।
তাছাড়া যদিও কোনো কারণে সন্তান মাদকাসক্তে অাক্রান্ত হয়ে পড়ে তাহলে তাকে বকা-ঝকা করা যাবেনা।তার সাথে ভালে ব্যবহার করতে হবে।ভালে ব্যবহারের মাধ্যমে তাকে ধীরে ধীরে এ পথ থেকে বের করে অানতে হবে।প্রয়োজনে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে,চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।একবার মাদকাসক্ত থেকে ফিরে অাসলে পুনরায় যেনো অাবার মাদকাসক্ত না হয় তার ব্যপারে সতর্ক থাকতে হবে।সন্তানদের জন্য নির্মল পরিবেশ তৈরি সহ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তাকে লালন-পালন করতে হবে।অামরা প্রত্যেকেই চাই অামাদের সন্তানরা ভালে থাকুক,সুস্থ্য থাকুক। এজন্য অামাদের উচিত সব সময় তাদের প্রতি বন্ধুসুলভ অাচারণ করা এবং সহানুভূতিশীল হওয়া।
সরকারের একার পক্ষে দেশে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।এজন্য প্রয়োজন সবার অান্তরিকতা ও সহযোগিতা। সবার ঐক্যন্তিক প্রচেষ্ঠা ও অান্তরিকতাই পারে দেশ থেকে মাদকের নিয়ন্ত্রণ কমাতে।