ভোগান্তির শেষ নেই ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধন সনদ পেতে

122

মো: জাবের হোসেন : ২০২১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে স্কুলে ভর্তি, এসএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন, পাসপোর্ট সহ আরো কিছু ক্ষেত্রে জন্ম নিবন্ধন আবশ্যক করে সরকার। জন্ম নিবন্ধন সনদ ডিজিটাল করা নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন দেশের লাখো মানুষ। প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষকে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা থেকে শুরু করে পৌরসভা এবং সিটি কর্পোরেশনে যেতে হচ্ছে শুধু এই জন্ম নিবন্ধন কাজের কারনে। কিন্তু ভোগান্তি আর বিড়ম্বনার যেনো শেষ নেই এই কাজে। আজ এখানে সমস্যা তো কাল অন্যখানে সমস্যা। আর এভাবেই প্রতিনিয়ত ছুটতে হচ্ছে জন্ম নিবন্ধন প্রত্যাশিদের। কেউ সন্তানের জন্য আবার কেউ নিজের জন্য দৌঁড়াচ্ছে। তবুও অনেকেই পাচ্ছে না জন্ম নিবন্ধন সনদ। কারন ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধন সনদ করতে গেলে বাবা-মার জন্ম নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র আবশ্যক। জাতীয় পরিচয়পত্র সকল অভিভাবকের থাকলেও নেই জন্ম নিবন্ধন সনদ। আবার অনেকের জন্ম নিবন্ধন সনদ থাকলেও সেটি হাতে লেখা হওয়ার কারনে পূণরায় ডিজিটাল করতে হচ্ছে। আর বিড়ম্বনা এখান থেকেই শুরু হচ্ছে।
সরোজমিনে তালা উপজেলার নগরঘাটা ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে দেখা গেছে, শুধু জন্ম নিবন্ধন সনদের জন্য প্রতিনিয়ন শত শত মানুষ ভিড় করছে। কেউ সন্তানের স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য আবার কেউ জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে অবহেলার কারনে না করার ফলে এখন করছেন। শুধু জন্ম নিবন্ধন সনদের কাজ করতে গিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের সচিব, কম্পিউটার অপারেটর থেকে শুরু করে সেখানে কর্মরত সকলেই ব্যস্থ থাকছেন দিনের অধিকাংশ সময়। এমনকি দিনে কাজ শেষ করতে না পেরে বাড়ি গিয়েও অনেকেই রাতে কাজ করছেন বলে জানা গেছে। তারপর আছে আবার ইন্টারনেট জনিত সমস্যা। অনেক সময় সার্ভারের সমস্যাজনিত কারনে দীর্ঘসূত্রিতা আরো বেশি হয়। এতে করে একদিকে যেমন ইউনিয়ন পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যাঘাত ঘটছে অন্যদিকে সনদপ্রত্যাশিরা ভোগান্তির স্বীকার হচ্ছেন। তবে এ সমস্যা থেকে সমাধানের কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেনা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন,  কিছুদিন বছর আগে তাদের ডিভোর্স হয়। তার সন্তানের বয়স এখন ৯ বছর। সন্তানের ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধন সনদ আগে করা ছিলোনা। হাতে লেখা জন্ম নিবন্ধন সনদ দিয়ে তিনি সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। কিন্তু স্কুল থেকে বলছে এখন ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধন সনদ লাগবে। কয়েকবার ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে ফিরে এসছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। কারন ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধন সনদ করতে গেলে বাবা-মায়ের উভয়ের ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধন সনদের ফটোকপি জমা দিতে হবে। কিন্তু আমার সন্তানের বাবার হাতে লেখা জন্ম নিবন্ধন সনদ ছাড়া আমার কাছে অন্যকিছু নেই। সন্তানের বাবার ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধন করা নেই। এখন আমি তার ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধন সনদ কোথায় পাবো? অনেক চেষ্টা করেও আমি তার ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধন সনদ জোগাড় করতে পারিনি। কারন সন্তানের বাবা যদি ডিজিটাল না করেন তাহলে আমি কোথা থেকে পাবো। তাছাড়া তার সাথে আমার সম্পর্ক না থাকায় তিনি ডিজিটাল তো দূরের কথা হাতে লেখাটাও দিবে না। নিরুপায় হয়ে কয়েকবার চেষ্টা করে ব্যার্থ হয়ে ফিরে এসেছি।
তিনি আক্ষেপ করে আরো বলেন, আমার সন্তানের স্কুল থেকে উপবৃত্তির জন্য ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধন সনদ চেয়েছিলো কিন্তু সেটা দিতে না পারার কারনে স্কুল থেকে উপবৃত্তির টাকা দেইনা। আমার সন্তানের সহপাঠিরা যখন উপবৃত্তির টাকা তোলো তখন আমার সন্তানের অবুঝ মনে কষ্ট হয়। আমার সন্তানের কষ্ট দেখে আমি খুব ব্যাথিত হই। তাই সরকারে কাছে বিনীত অনুরোধ যাতে করে ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধন সনদ সহজপ্রাপ্য হয় সে-ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।
এদিকে গত ৬ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকায় একটি সেমিনার হলে বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট (এএসডি) আয়োজনে “সুবিধাবঞ্চিত শিশুর সুরক্ষায় জন্ম সনদের ভূমিকা” শীর্ষক এক গোরটেবিল বৈঠকে বক্তারা অভিযোগ তুলে ধরে বলেন, সরকার জন্ম নিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক করেছে কিন্তু  এখনও দেশের  বৃহৎ জনগোষ্ঠী নিবন্ধনের বাইরে রয়েছে। নানা জটিলতার কারণে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্ম সনদ নিয়ে চরম ভোগান্তি স্বীকার হতে হচ্ছে। এই জন্ম সনদ পাওয়া না পাওয়ার বিষয়টি প্রভাব ফেলছে অভিভাবক ও কোমলমতি শিশুদের ওপর। অবিভাবকদের সাথে মানসিক চাপে ভুগছে সাধারণ শিশুরাও। এই মানসিক চাপ শিশুর জন্য মারাতœক ক্ষতির কারন হতে পারে বলে মনে করেন তারা। বৈঠকে বক্তারা আরো বলেন, অনেক সুবিধাবঞ্চিত এবং পথশিশুর বাবা-মা কিংবা অভিভাবক না থাকার কারনে শিশুটির জন্ম নিবন্ধন সনদ করা সম্ভব হচ্ছেনা। অপরদিকে বস্তিবাসী এবং কর্মজীবী শিশুদের বাবা-মায়েদের বেশিরভাগেরই জন্ম নিবন্ধন সনদ নেই আবার অনেকের হাতে লেখা যার বেশিরভাগেরই অনলাইন নেই। অবার যাদের অনলাইনে আছে তাদের বেশিরভাগই ভূলে ভরা, যার বাংলা কিংবা ইংরেজি নামের সাথে মিল নেই।
২০২১ সালের ১ জানুযারি থেকে চালু হওয়া আইন অনুযায়ী ২০০১ সালের পর জন্মগ্রহণকারী সবার জন্য জন্ম নিবন্ধন করতে হলে তার পিতা-মাতার জন্ম নিবন্ধন অবশ্যই প্রয়োজন হবে। তাই পিতা-মাতার জন্ম নিবন্ধন না থাকলে ২০০১ সালের পর জন্ম নেওয়া সন্তান জন্ম নিবন্ধন করানো যাবে না।
তাই সরকারের কাছে সাধারণ জনগন সহ সচেতন নাগরিকেরা জোর দাবি জানিয়েছেন যাতে করে দ্রুত জন্ম নিবন্ধন আইন সহজ করে সাধারণ নাগরিকের ভোগান্তি দূর করা হয়।