ফুটন্ত শাপলা ফুলের স্বর্গ সাতলা বিল

1211

অনলাইন ডেস্ক : একটি পিচঢালা পথ চলে গেছে গ্রামের শেষ মাথায়। পথের একপাশে সন্ধ্যা নদী, অন্যপাশে লাল শাপলার গালিচা। অনেক দূর অবধি চোখ ছুটে যাবে ফুটন্ত শাপলার গালিচা পেরিয়ে। দেখলে মনে হবে, স্বচ্ছ পানির উপরে লাল আর সাদা শাপলা ফুলের বড় এক প্রাকৃতিক স্বর্গ সৃষ্টি করে দাঁড়িয়ে আছে আপনার অপেক্ষায়। ফুটন্ত শাপলা ফুলের স্বর্গে নৌকায় আপনি ভেসে বেড়াচ্ছেন এপার থেকে ওপারে। লাল শাপলাগুলো আপনার নৌকা ঘেঁষে আপনাকে আগমনী শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। সেই শাপলাগুলো হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করা যাবে নিমিষেই। ভাবতেই ভালো লাগছে!

এ দৃশ্য সত্যিকারে দেখতে প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক যাচ্ছেন সাতলা বিলে। লাল শাপলার অভয়ারণ্য সাতলা বিল এখন ভ্রমণপিপাসুদের কাছে একটি দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে। বরিশাল জেলার উজিরপুর উপজেলার একটি ইউনিয়ন সাতলা। বরিশাল সদর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে সাতলা গ্রামের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই শাপলা বিল। গ্রাম সাতলার নামানুসারে শাপলার এই বিলের নাম হয়েছে সাতলা বিল। তবে স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, গ্রামের নামকরণেও আছে এই শাপলার অবদান। অনেক আগে থেকেই এই এলাকায় প্রাকৃতিক নিয়মে অনেক শাপলা ফুল ফুটতো। স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষায় শাপলাকে ‘হাতলা’ বলা হতো। সেই হাতলা শব্দ থেকেই পরিবর্তিত নাম হয়েছে সাতলা।

সবুজ বিলে লাল শাপলাগুলো দেখে মনে হবে এই বিলের পরতে পরতে হাজার হাজার বাংলাদেশের পতাকা ছড়িয়ে আছে। নিটল বাংলার এ এক মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্য। জাতীয় ফুল শাপলার এমন দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় যেকোনো বাঙালির। সকালের সূর্যের সোনালি রোদ আর শেষ বিকেলের গোধূলিলগ্নের আভা শাপলার বিলে যেন নতুন একটি মাত্রা যোগ করে। খুব সকালে যেতে পারলে ফুটন্ত শাপলা দেখা যায়, সকাল দশটার পরে অর্থাৎ রোদের তীব্রতা বাড়লে শাপলা তার পাপড়ি গুটিয়ে নেয়। সন্ধ্যার পরে আবার ফুলগুলো ফুটতে শুরু করে। সম্পূর্ণ গ্রামের প্রায় ১০০ জনের মালিকানাধীন জমি রয়েছে এ বিলে। গ্রামের মানুষের দেয়া তথ্যমতে, আনুমানিক ৬০০ একর জমিজুড়ে সাতলা বিলের অবস্থান। প্রাকৃতিকভাবেই এ গ্রামের বড় এই বিলে যুগ যুগ ধরে অতিথি পাখির মতো ফিরে আসে শাপলা। স্থানীয় কৃষিসংশ্লিষ্টরা জানালেন, প্রতি বছর জৈষ্ঠ্য থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত মোট ছয় মাস এই সাতলা বিলে পানি জমে থাকে। বছরের ছয় মাস বিলে পানি জমে থাকার কারণে বিলটি এক ফসলা জমিতে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর ধানের মৌসুমে জমিতে চাষ দেয়া হলেও মাটির সঙ্গে মিশে থাকছে শাপলা-শালুকের বীজগুলো। ফলে পরের বছরে বিলে পানি আগমনের সঙ্গে সঙ্গে এই বীজ থেকেই আবার শাপলার জন্ম হচ্ছে। ভাদ্র-আশ্বিন-কার্তিক এই তিন মাস এ বিলের পানিতে জেগে ওঠে শাপলা।

যোগাযোগ ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা ও ভাঙা রাস্তাঘাটের কারণে শাপলাসমৃদ্ধ এ গ্রামটি পর্যটকদের নজরের বাইরেই ছিল বিগত বছর দুয়েক আগেও। তবে বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটার ফলে দূর থেকে পর্যটকরা ছুটে আসছেন। সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকার কল্যাণে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সমৃদ্ধ এই শাপলার বিলটি বর্তমানে পর্যটন সম্ভাবনায় স্থানে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি পর্যটকদের নানা ধরনের চাহিদা পূরণের মাধ্যমে স্থানীয় দরিদ্র মানুষের জীবিকার অন্যতম উৎস হয়ে উঠেছে বিলটি। একে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষে স্থানীয় জনগণ ইতিমধ্যে চেষ্টা শুরু করে দিয়েছেন। সামান্য কিছু মজুরি বা বকশিসের বিনিময়ে নৌকায় বিল ঘুরিয়ে দেখানো, খাবারের ব্যবস্থা করে দেয়া, ব্যাগ রাখার সুব্যবস্থা করা, গাড়ি বা মটরসাইকেল পার্কিং ও পাহারার দায়িত্ব নিচ্ছে স্থানীয় মানুষগুলো। বিলে আগত দর্শনার্থীদেরকে নৌকায় ঘুরিয়ে বিল দেখাতে প্রস্তুত থাকে একাধিক নৌকা। নৌকা প্রস্তুত করে প্রতিদিন বিলের একাধিক পয়েন্টে অপেক্ষা করে মাঝিরা। দর্শনার্থীদের নিয়ে শাপলার বিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নৌকায় বৈঠা চালিয়ে যা রোজগার হয় তা দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করে এ বিলের মাঝিরা। নৌকার মাঝি রবি বলেন, ‘আমরা প্রায় ২০টি পরিবার এই বিলের ওপরে নির্ভরশীল, ধানের মৌসুমে এই বিলেই আমরা বদলা (দিনমজুর) খাটি। পানি আসলে জমিওয়ালারা মাছ ছাড়ে, তখন আমরা মাছের কাজ করি। আবার শাপলার বিলে দর্শনার্থীদের নৌকায় ঘুরিয়ে ইনকাম করি এই মৌসুমে। সব মিলিয়ে আমরা সারা বছর সাতলা বিলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকি।’

সাতলা বিলে ঘুরতে আসা পর্যটক আব্দুল কাদের বলেন, ‘আমরা বন্ধুরা মিলে শাপলার এই বিল দেখতে এসেছি। এ নিয়ে তিন বার আসলাম এখানে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি বাংলাদেশের এই রূপ আমাকে বিমোহিত করেছে। পাশাপাশি এখানে পর্যটন সম্ভাবনার একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। বরিশাল শহরের পার্শ্ববর্তী হওয়ায় এ বিল এখন ভ্রমণপ্রিয় মানুষের আগ্রহের জায়গা হয়ে উঠেছে।’

যেভাবে যাবেন : বরিশাল সদরের নথুল্লাবাদ থেকে সাতলার উদ্দেশ্যে বাস ছেড়ে যায়। নতুল্লাবাদ থেকে রিজার্ভ গাড়িতেও যাওয়া যাবে সাতলা পর্যন্ত।