মো. আব্দুস সাত্তার: শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষা ছাড়া পৃথিবীর কোন জাতি উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছাতে পারিনি আর অদূর ভবিষ্যতেও পারবেনা। যে জাতি যতবেশি শিক্ষিত, সে দেশ বা জাতি ততবেশি উন্নত। বিশ্বের উন্নত দেশের দিকে লক্ষ্য করলে আমরা সহজেই উপলব্ধি করতে পারি সে দেশ কতটা শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে। আজ ভারত, চীন, জাপান, মালেশিয়া, সিংগাপুর, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র উন্নতির স্বর্ণ শিখরে পৌঁচ্ছাছে। তার অন্যতম একটি কারণ হল শিক্ষার প্রতি অধিক গুরুত্ব দেওয়া। তাই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি আমাদের সবাইকে এক যোগে শিক্ষার, বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান অর্জনে কাজ করতে হবে।
শিক্ষার বিভিন্ন ধাপ রয়েছে। প্রাথমিক স্তরকে বলা হয় সকল শিক্ষা স্তরের ভীত। এই ভীত যদি শক্তিশালী হয় তাহলে শিক্ষার অন্যান্য স্তর টেকসই হবে। আর প্রাথমিক শিক্ষার ভীত যদি নড়বড়ে হয় তাহলে শিক্ষার অন্যান্য স্তর গুণগত মান নিশ্চিত হবে না। প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান অর্জনে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, সোনার বাংলার কারিগর, বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সংবিধানে ১৭নং অনুচ্ছেদে প্রাথমকি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কণ্যা, ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা মাননীয় প্রধান মন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ০১-০১-২০১৩ সালে ২৬,১৯৩ টা রেজিস্টার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেছেন। প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করণে ইতিপূর্বে অন্যকোন সরকার এতটা গুরুত্বারোপ করেনি। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহী কৌতুহলী ও মনোযোগী করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য ও সার্বিক নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ সরকার ২০০৯ সাল থেকে পাঠ্যপুস্তক গুলো চার রঙে উন্নতী করে আকর্ষণীয় টেকসই ও বিনামূল্যে বই বিতরণ করার মহাৎ উদ্যোগ গ্রহন করেছে। সরকার সারাদেশে সকল শিক্ষার্থীর নিকট প্রাথমিক শিক্ষার গুনগত মান নিশ্চিত করতে ১লা জানুয়ারীতে বই হাতে তুলে দিচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষার গুনগত মান নিশ্চিতকরনে সরকারের উল্লেখযোগ্য দিক হলো ১০০% উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা। দরিদ্রপীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং কার্যক্রম পরিচালনা করা। পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে কায়েকটি জেলায় গরফ-উধু-গবধষ পরিচালনা করা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা। ক্ষুদ্র মেরামত ও রুটিন মেরামত বরাদ্ধ প্রাক-প্রাথমিক বরাব্ধ , দূর্যোগ সহ বিভিন্ন বরাদ্ধ দেয়া, যোগ্য শিক্ষাক নিয়োগ, গ্রেড বৈষম্য দূরীকরণ প্রাঃ শিক্ষকদের ২য় শ্রেণী ঘোষণা প্রভূতি।
প্রাথমিক শিক্ষার গুনগত মান নিশ্চিত করতে সরকারের পাশাপাশি আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। বর্তমান সরকার শিক্ষা বান্ধব সরকার তাই, দেশকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে আমাদের যার যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। শিশুকে নিয়ে চিন্তা ভবনার শেষ নেই। প্রত্যেকটি শিশু পরিবারের আর্শিবাদ স্বরূপ। প্রত্যেকটি শিশুর সাথে পারিবারের হাসি আনন্দ জড়িত। সারাদিন কর্মক্লান্তির পর শিশুর মিষ্টি মুখ ও পবিত্র হাসি দেখলে যেন সারাদিনে কষ্ট, মুহূর্ত বিলীন হয়ে যায়। এই ধারায় যত পবিত্র জিনিস আছে। তার মধ্যে শিশু অন্যতম। তাই শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার গুনগত মান নিশ্চিত করতে আমাদের সবাইকে গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে একজন শিক্ষক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। শিক্ষা সম্প্রসারণ ও জ্ঞান বিরতরণের ক্ষেত্রে একজন শিক্ষক শিক্ষা ও সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ অভিভাবক। শিক্ষকেরা হচ্ছে জাতির বিবেক। একটি জাতিকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে একজন শিক্ষকের ভূমিকা অগ্রগণ্য। শিক্ষকতা একটি মর্যাদাশীল ও মহান পেশা। শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে শিক্ষকদের নিয়মিত, সুষ্ঠু, আনন্দঘন পরিবেশে, বাস্তবধর্মী উপকরণ এবং পদ্ধতিমাপিক পাঠদান গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীতে যে জাতি যত বেশি সুশিক্ষিত; সেই জাতি গঠনে শিক্ষকদের ভূমিকা সব থেকে বেশি। শিক্ষকতা শুধুমাত্র এটি পেশা নয় বরং এটি অত্যন্ত সম্মানজনকও বটে। যেসব দেশে শিক্ষকদের মান যত বেশি; সেসব দেশের শিক্ষার মানও বেশি। শিক্ষকতা একটি রোল মডেল।
বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই বাংলাকে সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন। আর সোনার বাংলা গড়তে হলে চাই সোনার কারিগর। শিক্ষকরাই হচ্ছে জাতি গড়ার কারিগর। শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতকরণে শিক্ষকদের সব থেকে বেশি আন্তরিকতা ও ইচ্ছা শক্তি প্রবল করতে হবে। সে যখন বিদ্যালয়ে প্রবেশ করবে; তখন প্রবেশ পথ থেকে তার সকল প্রকার চিন্তা ভাবনা মাথা থেকে দূর করতে হবে। এক মনে, এক ধ্যানে নিজেকে আত্মনিয়োগ করতে হবে। ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে গবেষণা করতে হবে। শিক্ষকদের একাধারে বিভিন্ন গুণে গুণান্বিত হতে হবে। সে যখন শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করবে; তখন ১০০% প্রস্তুতি নিয়ে ক্লাসে যেতে হবে। কোন শিক্ষার্থী কোন বুদ্ধিমত্তার প্রবল তা তাকে অনুসন্ধান করতে হবে। পাঠদানের সময় অবশ্যই যুগপোযোগী ও আকর্ষণীয় উপকরণ ব্যবহার করতে হবে। কোন শিক্ষার্থী অ-মনোযোগী হলে তাকে নিরাময় মূলক ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি তাকে অতিরিক্ত সময় দিতে হবে। তার গার্ডিয়ানকে তার সমস্যাগুলো তুলে ধরতে হবে। আমার মতে, শিক্ষক এবং অভিভাবকরা যৌথভাবে চেষ্টা করলে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব।
একজন শিক্ষক সমাজের নেতা; ঐ ক্যাচমেন্ট এলাকার একজন গূণী ও সম্মানীয় ব্যক্তি। একজন শিক্ষক বন্ধুর মতো আচরণ করে তাকে পঠন-পাঠন কাজে ১০০% নিয়োজিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, একজন শিক্ষার্থী কিন্তু তার পিতামাতা থেকে শিক্ষকের কথা বেশি অনুসরণ করে। যে শিক্ষার্থী ২/৩ দিন অনুপস্থিত থাকে; শিক্ষক যদি হোমভিজিট করে তার গার্ডিয়ানকে শিক্ষার গুরুত্ব এবং শিক্ষার্থীদের আগামী ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভালভাবে বুঝাতে পারে। তাহলে ঐ গার্ডিয়ান সচেতন হবে এবং ঐ শিক্ষার্থীও আর অনুপস্থিত থাকবে না। শিক্ষক ও অভিভাবককে আরো বেশি সচেতন ও দায়িত্বপূর্ণ হতে হবে।
শিক্ষার গূণগত মান উন্নয়নে প্রধান শিক্ষক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কথায় আছে “As is the headmaster; So is the school.’ জমির মালিক যদি কাজ না করে শুধু দাড়িয়ে থাকে; তারপরেও শ্রমিকরা বাধ্য হয়ে হলেও তারা কাজে ফাঁকি দিতে পারে না। তারা সঠিক সময়ে পুরোপুরি কাজ সম্পাদন করে। তাই প্রধান শিক্ষক যদি বিদ্যালয়ে সবসময় অর্থাৎ (৯.০০-৪.৩০টা) অবস্থান করেন; তাহলে অন্যান্য শিক্ষকরাও কাজ করার আগ্রহ পান। প্রধান শিক্ষক যদি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে করেন তবে অন্যান্য শিক্ষকরা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য অবহেলা করতে পারেন না। প্রধান শিক্ষক যদি বিভিন্ন অজুহাতে বিদ্যালয়ের বাইরে অবস্থান করেন বা ঋধপবনড়ড়শ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন বা ব্যক্তিগত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প করেন তাহলে অন্যান্য শিক্ষকরাও তাদের উপর অর্পিত দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করতে পারে না। তাই শরীলের মাথা যদি ঠিক থাকে; তাহলে শরীরের অন্যান্য পার্টস সবই ঠিক থাকে। আর মাথা যদি ঠিক না থাকে; তাহলে শরীরের অন্যান্য পার্টস সঠিকভাবে কাজ করে না। তাই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে সব থেকে বেশি দায়িত্ববান ও কর্তব্যপরায়ণ হতে হবে। তাই প্রধান শিক্ষককে অবশ্যই আগমন/প্রস্থান ঠিক করতে হবে। নিয়মিত পাঠদান করতে হবে। শ্রেণী পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি দাপ্তরিক কাজও সম্পাদন করতে হবে। প্রতি বৃহস্পতিবারে ঞঝঘ পদ্ধতিতে পাঠদান পরিচালনা করতে হবে। কোন শিক্ষকের প্রশিক্ষণ না থাকলে বা নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত হলে; তাকে পরামর্শের ভিত্তিতে যোগ্য করে তুলতে হবে; তাকে সশরীরে নিয়মিত হোমভিজিট করতে হবে। সহকর্মীদের সাথে ভ্রাতৃত্ব বা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে- বিদ্যালয়টি তার একার সম্পদ নয়। এখানে সবাই মিলে একসাথে যদি আন্তরিকতা দিয়ে কাজ করা যায় তাহলে শিক্ষার গুণগত মান অর্জন করা সম্ভব।
প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান অর্জনে শিক্ষকের পাশাপাশি ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়ার প্রতি বেশি করে যন্তশীল হতে হবে। অভিভাবকদের আরও বেশি যত্নশীল এবং সচেতন হতে হবে। রুট লেবেলে আরও বেশি মনিটরিং এর ব্যবস্থা করতে হবে, খবরদারি নয়, নয় লৌকজ পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ ও বন্ধুত্বপূর্ণ আচরনে প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান অর্জন করা সম্ভব।
পরিশেষে প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান অর্জন করতে হলে সরকারকেও মূখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। অবকাঠামোগত দিক উন্নয়ন করতে হবে। স্বচ্ছ ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। পৃথক বেতন কাঠামো ও সামাজিক মর্যাদা দিতে হবে। বর্তমানে গ্রেড বৈষম্য দূরীকরণ এবং প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড ও গেজেটেড পদমর্যাদা দিতে হবে। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকে ৪ বছর থেকে শুরু করতে হবে। ১ : ২৫ অনুপাতে ছাত্র শিক্ষক বিভাজন করতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষকের পাশাপাশি চাকা/শাশি/সংগীতের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নিয়োগ দিতে হবে। বিষয়ভিক্তিক শিক্ষকের নিয়োগ দিতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর জন্য আলাদা আলাদা বোর্ড গঠন করতে হবে। সর্বোপরি শিক্ষার উপর বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষার উপর সবথেকে বেশি বাজেট বরাদ্ধ করতে হবে। তাহলে শিক্ষার গুণগতমান অর্জন করা সম্ভব হবে।
লেখক : মো. আব্দুস সাত্তার
প্রধান শিক্ষক, ০৬নং নগরঘাটা বোর্ড স.প্রাবি
তালা, সাতক্ষীরা।