মো. জাবের হোসেন : তালা উপজেলার নগরঘাটা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের পিয়ন মো. সারিকুর রহমান শূণ্য থেকে কোটিপতি বনে গেছেন। একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী মো. সারিকুর রহমানের জীবন আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার মতো ঘটে যাওয়া ঘটনা। আলাদিনের চেরাগের জাদুতে যেন হতদরিদ্র থেকে কোটিপতি বনে যাওয়ার বাস্তব চিত্র। অভিযোগ উঠেছে, অফিস সহায়ক হলেও ইউনিয়ন ভূমি অফিস পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করেন মো. সারিকুর রহমান।
এ বিষয়ে উপজেলার নগরঘাটা ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ নগরঘাটা গ্রামের আনছার আলী বলেন, আমি নগরঘাটা ভূমি অফিসে জমির খাজনা দেওয়ার জন্য যায়। গিয়ে সারিকুর ভাইর কাছে প্রথমে পরামর্শ নেই। তিনি আমাকে হিসাব দিলেন যে, দুইটি খাজনার জন্য ২৭ হাজার টাকা খরচ হবে। আমি কম হবে কিনা তাকে বললে তিনি বলেন কোনো কম হবেনা। এরপর আমি বাড়িতে ফিরে আসি। এভাবে ৪/৫ দিন আমি ভূমি অফিসে সারিকুর ভাইর কাছে যাতায়াত করতে থাকি। একদিন আশ্বাস দিয়ে আমাকে যেতে বলেন। আমি ভূমি অফিসে তার কাছে যাওয়ার পর কথা-বার্তা শেষে সারিকুর ভাই আমার কাছ থেকে ১১ হাজার টাকা নেন দুইটা দাখিলার জন্য। যার একটা খতিয়ানে ৬৮ শতক জমি, অন্যটিতে ১২২ শতক জমি। ৬৮ শতক জমিতে খাজনা দেখিয়েছেন ১৩৮ টাকা এবং ১২২ শতক জমিতে খাজনা দেখিয়েছেন ২৪৪ টাকা। মোট ৩৮২ টাকা খাজনা দেখিয়েছেন সারিকুর ভাই, অথচ তিনি আমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন ১১ হাজার টাকা নিয়েছেন।
নগরঘাটা ইউনিয়ন পরিষদের ৪,৫,৬ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য মোছা. ছবিরননেছা বলেন, আমি নগরঘাটা ইউনিয়ন ভূমি অফিসে ০১ শতক জমির কাজের জন্য গেলে ফজলু ভাই যেখানে কোনো টাকা ছাড়াই করে দিতে বলে দিয়েছিলেন সেখানে পিয়ন সারিকুর আমার কাছে ৬ হাজার টাকা দাবি করেন। পরের দিন গেলে সারু আমার কাছ থেকে ৪০০ টাকা নেন হোল্ডিং খোলা বাবদ। আমি সারুর সকল অন্যায়-অপকর্মের বিচার দাবি করছি।
একই ইউনিয়নের মঠবাড়ি গ্রামের মো. মনিরুজ্জামান বলেন, আমার পৌত্রিক জমিতে ৪টি মেহগনী গাছ ছিলো রাস্তার পাশে। সেটি আমি বিক্রি করে দেওয়াতেই নগরঘাটা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের পিয়ন সারিকুর রহমান জানতে পারে। তিনি এসে আমাকে হুমকি-ধামকি দিয়ে বলেন গাছ কেনো আমি বিক্রি করেছি? তারজন্য তোমার নামে মামলা হবে, পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে, নানারকম ঝামেলা হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। পরে সারিকুর রহমান আমার কাছে ৫ হাজার ৫০০ টাকা টাকা দিতে হবে বলেন। তিনি বলেন, ৫ হাজার ৫০০ টাকা দিলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এরকম ভয়-ভীতি দেখিয়ে তিনি আমার কাছ থেকে ৫ হাজার ৫০০ টাকা নেন।
নগরঘাটা গ্রামের আরো অনেকেই অভিযোগ তুলে বলেন, ভূমি অফিসে গেলে পিয়ন সারিকুরের চাহিদা মাফিক টাকা দিতে না পারলে তার ব্যবহার খারাপ হয়ে যায়, তিনি খারাপ ব্যবহার করেন। সেবা দিতে চান না। বিভিন্ন সমস্যা দেখিয়ে কাজ আটকে রাখেন। উপায় না পেয়ে এক সময় বাধ্য হয়ে তাকে অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে কাজ করতে হয়।
অফিস সহায়ক মো. সারিকুর রহমানের ব্যাপারে নগরঘাটা ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকে সেবা গ্রহীতাদের কাছে জানতে চাইলে স্থানীয় অনেকেই অভিযোগ তুলে বলেন, ভূমি অফিসে দাখিলা প্রদান করতে গেলে বেশি টাকা নিয়ে অল্প টাকা তুলে দেন দাখিলায়। প্রতি মাসে শত শত মানুষ দাখিলা প্রদান করে থাকেন বৃহৎ দুইটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত নগরঘাটা ইউনিয়ন ভূমি অফিসে। সরকারি কোষাগারে প্রতি মাসে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে অফিস সহায়ক মো. সারিকুর রহমান অল্প টাকা ভূমি কর দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বেশি টাকা নিয়ে নিজের পটেক ভারি করে চলেছেন। এতে করে একদিকে যেমন সরকারের আয় কমে যাচ্ছে, অপরদিকে সেবা গ্রহণকারীরা যেমনটা প্রতারিত হচ্ছে ঠিক তেমনিভাবে লাভবান হচ্ছেন অফিস সহায়ক সারিকুর রহমান।
ভূমির নামজারি অর্থাৎ মিউটেশন করতে গেলে সরকার নির্ধারিত ফি যেখানে ১১০০ টাকা সেখানে তাকে প্রদান করতে হয় ৬ হাজার টাকা বা তারও বেশি। ভূমি অফিসে বিভিন্নরকম কাজে গেলে সাধারণ নাগরিকদের তার মাধ্যমে নানারকম হয়রানি সহ বিবিধ সমস্যার সম্মুখিন হতে হয়।
অফিস সহায়ক মো. সারিকুর রহমানের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেছে, তিনি বিগত ৩ বছর আগে নগরঘাটা ইউনিয়ন ভূমি অফিসে চাকরি করতেন। তারপর তিনি বদলি নিয়ে ২ বছর অন্যত্র চলে যান। আনুমানিক ২ বছর পর তিনি বিগত প্রায় ৯ মাস আগে নগরঘাটা ইউনিয়ন ভূমি অফিসে পূণরায় বদলি নিয়ে কাজ করছেন। তার বাড়ি পাশ্ববর্তী ধানদিয়া ইউনিয়নে। একজন পিয়ন হয়ে কীভাবে তিনি দুই তলা বিলাসবহুল কোটি টাকার বাড়ি করেছেন, নিজ নামে ১৫ বিঘার মত জমি ক্রয় করেছেন সেটি নিশ্চই আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার মত ঘটনা! এছাড়াও রয়েছে তার বহু সম্পত্তি নিজ নামে ও পরিবারের সদস্যদের নামে।
স্থানীয়দের দাবি নগরঘাটা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের অফিস সহায়ক মো. সারিকুর রহমানের বিরুদ্ধে সঠিক তদন্ত করে তার সকল অবৈধ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হোক। সাধারণ জনগণের ইউনিয়ন ভূমি অফিসে সেবা গ্রহণে যাতে ভোগান্তি না হয় সেজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট জোর দাবি জানিয়েছেন। একইসাথে অসাধু অফিস সহায়ক সারিকুরে বিরুদ্ধে যাতে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় সেজন্য সহকারি কমিশনার (ভূমি) তালা, জেলা প্রশাসক সাতক্ষীরা, বিভাগীয় কমিশনার খুলনা সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট জোর দাবি জানিয়েছেন এলাকার সচেতন মহল।
এ ব্যপারে নগরঘাটা ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা অসীম কুমার হালদার বলেন, আমি এসব বিষয়ে কিছু জানিনা। মাত্র তিন মাস হলো আমি এখানে যোগদান করেছি, তবে বিষয়গুলো তদন্ত করে আমি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো বলে জানান।
এ ব্যাপারে তালা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি), আরাফাত হোসেন বলেন, আপনি একটা লিখিত অভিযোগ দিলে আমি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবো।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মো. হুমায়ূন কবিরের মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তিনি রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।