পাবলিক পরীক্ষায় এমসিকিউ থাকছে না : শিক্ষা সচিব

24

পাবলিক পরীক্ষায় এমসিকিউ (নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন) তুলে দেয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। এর পরিবর্তে ছোট প্রশ্ন প্রবর্তন করা হবে। প্রশ্নফাঁস রোধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই পদক্ষেপ নিতে চাচ্ছে।

এ সংক্রান্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে আসন্ন জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায়ই এমসিকিউ বাদ দিয়ে ছোট প্রশ্ন প্রবর্তন করা হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন বৃহস্পতিবার বিকালে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।এর আগে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে পাবলিক পরীক্ষা সংক্রান্ত জাতীয় আইনশৃঙ্খলা ও মনিটরিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভার সদস্যরা প্রশ্নফাঁস রোধে পাবলিক পরীক্ষা থেকে এমসিকিউ তুলে দেয়ার সুপারিশ করেন। এছাড়া নির্বিচারে পরীক্ষা কেন্দ্র অনুমোদন না দেয়া এবং ভেন্যু কেন্দ্র বাতিলের পরামর্শ দেন। সদস্যদের পরামর্শের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সভায় বলেন, প্রশ্নফাঁসের কেন্দ্র হিসেবে এমসিকিউয়ের বিষয়টি চলে এসেছে।

ছেলেমেয়েদের জন্য বিষয়টি বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানাব। তিনি আরও বলেন, জেএসসি- জেডিসির ক্ষেত্রে নতুন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। খুব শিগগির এটা নিয়ে নতুন পরিকল্পনা করব।

সভার শুরুতে এবারের এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এ সময় শিক্ষামন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, এবারের এসএসসি পরীক্ষায় ১৭ বিষয়ের মধ্যে ১২ বিষয়ের এমসিকিউ প্রশ্ন ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ক্লোজ গ্রুপের মধ্যে ফাঁস হয়েছে।

এই ফাঁস হওয়ার ঘটনা ঘটে পরীক্ষার ২০ মিনিট আগে। এতে শিক্ষার্থীরা তেমন লাভবান হয়নি। তাছাড়া ২০ লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে সর্বোচ্চ ৫ হাজার এই সুবিধা পেয়ে থাকতে পারে।

যেটা মোট পরীক্ষার্থীর তুলনায় একটি ক্ষুদ্র অংশ। তাই এই পরীক্ষা বাতিল করা হবে না। যারা প্রশ্নফাঁসের সুবিধা পেয়েছে তাদের শনাক্ত করার কাজ চলছে। তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ফাঁসের সুবিধাভোগীদের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের ফল বাতিল করা হবে।শিক্ষামন্ত্রী বলেন, অনেকে বিচার বিশ্লেষণ না করেই ঢালাওভাবে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অপরাধী বানিয়েছেন। এটি আমাদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের গ্রেফতার করে দেখেছেন আসলে সেটি আসল প্রশ্নপত্র ছিল না। তিনি বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন তৈরি প্রচার করার আহ্বান জানান।

এদিকে তদন্ত কমিটি চার পৃষ্ঠার প্রতিবেদন দিলেও ওই সভায় সরবরাহ করা হয় দুই পৃষ্ঠা। চারটি সুপারিশসহ তদন্ত প্রতিবেদনের ওই সার-সংক্ষেপে বলা হয়েছে, সম্প্রতি শেষ হওয়া এসএসসি পরীক্ষায় ০.২৫ শতাংশ প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। শুধু ‘খ’ সেট বা নৈর্ব্যক্তিক ৩০ নম্বরের অংশ ফাঁস হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। মাদরাসা বোর্ডের কোনো প্রশ্নফাঁসের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

অন্যদিকে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং তদন্ত করে সুবিধাভোগী সব পরীক্ষার্থীকে চিহ্নিত করে ফলাফল বাতিলসহ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা, প্রশ্নফাঁস অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা, বিকাশ, রকেটসহ বিভিন্ন ব্যাংকিং মাধ্যমে লেনদেনকারীদের তথ্য সংগ্রহ করে সন্দেহজনক মোবাইল নম্বরগুলো চিহ্নিত করার সুপারিশ করা হয়েছে।

সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী কাজী কেরামত আলী, কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগের সচিব মো. আলমগীর, অতিরিক্ত সচিব রওনক মাহমুদসহ পুলিশ, র‌্যাব, এনএসআইসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। এছাড়া ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হকসহ বিভিন্ন বোর্ডের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।

আগামী ৬ মে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলপ্রকাশ করা হবে। এর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গণমাধ্যম ডেকে এ ঘোষণা দিল।

এমসিকিউ বাতিল ইস্যু : ওই সভায় তদন্ত কমিটির একাধিক সদস্য প্রশ্নফাঁস রোধে পাবলিক পরীক্ষা থেকে এমসিকিউ তুলে দেয়ার পরামর্শ দেন। তারা বলেন, এবারে যে ১২টি প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে তার সবই এমসিকিউ। কোথাও সিকিউ (সৃজনশীল প্রশ্ন) ফাঁসের কথা শোনা যায়নি। সহজে উত্তর দেয়া সম্ভব বলে এই প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটছে।

সদস্যদের বক্তব্য শেষে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এমসিকিউ সম্পর্কে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ নিয়ে নানা সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। এর মধ্যে এমসিকিউতে নম্বর কমানো হতে পারে, বা এক কথায় উত্তর যুক্ত করা যেতে পারে। সেটা হলে সৃজনশীল প্রশ্ন সংখ্যা বাড়তে পারে। বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। অতি শিগগিরই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানো হবে।

একই সভায় পরীক্ষা পরিবর্তন প্রসঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, চলমান পদ্ধতিতে পাবলিক পরীক্ষা চলতে থাকলে প্রশ্নফাঁস রোধ করা সম্ভব হবে না। এ কারণে আমরা পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তার আলোকে চলতি বছর শুরু হওয়া জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষায় পরিবর্তন আনা হবে। বিষয়টি চূড়ান্ত করতে সভা করা হবে। সেখানে অনেকের মতামত নিয়ে কী কী পরিবর্তন আনা যায় সেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

পরে নিজের কক্ষে আলাপকালে সোহরাব হোসাইন বলেন, বিভিন্ন মহল থেকে এ ব্যাপারে প্রস্তাব আসছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি দু’বছর ধরেই এ নিয়ে বলে আসছি। আমি মনে করি, এমসিকিউ যে উদ্দেশ্যে চালু করা হয়েছে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে তার বাস্তবতা এখন নেই। তাই এমসিকিউ তুলে দিয়ে ছোট প্রশ্ন ধরনের কিছু প্রবর্তন করা যায়। সেটা আসন্ন জেএসসি থেকেই সম্ভব। তবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয় জড়িত থাকায় এ ব্যাপারে ঘোষণা দিতে একটু সময় লাগবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বছরের চার মাস চলে গেলেও কোনো সমস্যা নেই। কেননা আমরা তো বই পরিবর্তন করছি না বা বইয়ে নতুন কোনো পাঠ সংযোজন করা হয়নি। একই পাঠ ও পাঠ্য। কেবল এমসিকিউয়ের পরিবর্তে ছোট প্রশ্ন পড়তে হবে। এ সময় তিনি যুক্ত করেন, ‘আমি এমন মতের পক্ষে। তবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কী হবে জানি না। যে সিদ্ধান্ত হয় সেটাই বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু এমসিকিউ এবারই বাতিল করা সম্ভব।’

এমসিকিউ বাতিলের নির্দেশনা হয়নি : দেশে পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তনসহ সার্বিক বিষয়ে কাজ করে বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট (বিইডিইউ)। জানা গেছে, এমসিকিউ বাতিল করে ছোট প্রশ্ন প্রবর্তনের মতো কোনো নির্দেশনা ওই ইউনিট এখনও পায়নি। যে কারণে সংস্থাটিতে এ ব্যাপারে কোনো কার্যক্রম চলছে না। বিষয়টি নিশ্চিত করে ইউনিটের পরিচালক রবিউল কবীর চৌধুরী বৃহস্পতিবার বিকালে বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা পাইনি। তবে নির্দেশনা পেলে কার্যক্রম শুরু করা হবে। তিনি আরও বলেন, প্রশ্ন কাঠামো সংযোজনের ব্যাপারে প্রথমে কাজ করে এনসিটিবি (জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ড)। সাধারণত কোনো শিক্ষাবর্ষের শুরুতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়।

গ্রেফতার ১০৬ : সভায় জানানো হয়, এসএসসি পরীক্ষার পর এবং এইচএসসি পরীক্ষা শুরু থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পুলিশ ১০৬ জনকে গ্রেফতার করেছে। তাদের মধ্যে অভিভাবক, প্রশ্নফাঁসের প্রলোভন দেয়া প্রতারক এমনকি শিক্ষার্থীও রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস ও পরীক্ষা দেয়ার সিন্ডিকেটের ২৩ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে আরেকটি সংস্থা জানিয়েছে।