এম এম নুর আলম, আশাশুনি : রোজ কত মানুষ মারা যায় আর কত মানুষ জন্ম গ্রহণ করে। কে তাদের কথা মনে রাখে? কিন্তু মাঝে মাঝে এমনও মহা মনিষী জন্মগ্রহণ করেন যাদের কথা মানুষ চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। এমনই একজন মহান শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি ছিলেন, সাতক্ষীরা সদরের জি-ফুলবাড়ি দরগাহ শরীফের পীর সুলতানুল আউলিয়া কুতুবুল আকতাব আরেফ বিল্লাহ হযরত শাহ সুফী খান আতিয়ূর রহমান (রহঃ)।
বাংলা ১৩১৬ সালে সদর উপজেলার ফিংড়ী ইউনিয়নের গোবরদাড়ি (জি-ফুলবাড়ী) গ্রামে এই মহান মনিষী জন্মগ্রহন করেন। তার পিতার নাম নছিমুদ্দীন খান, মাতা ফাতেমা খাতুন। তিন ভাই আর দুই বোনের মধ্যে খান আতিয়ূর রহমান (রহঃ) ছিলেন সবার বড়। পিতার আর্থিক দৈন্যতার কারণে শিশু বয়সে তিনি সাতক্ষীরা সদর উপজেলার পায়রাডাঙ্গা গ্রামে ফুফুর বাড়িতে থেকে লেখা পড়া করেন। এখানে থেকে তিনি স্থানীয় বাবুলিয়া হাইস্কুলে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত এবং পরবর্তীতে ভারতের চব্বিশ পরগনা জেলার হাকিমপুর হাইস্কুল থেকে ম্যাট্টিক পাশ করেন। অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার কারনে খান আতিয়ূর রহমান (রহঃ) এর লেখাপড়া আর বেশিদূর এগুতে পারেনি। এরপর জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করতে যোগ দেন পিতার সাথে। পিতার কাপড়ের দোকানে তিনি কাজ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে তিনি কুল্যা ইউনিয়নে গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচিত হয়ে সুনামের সাথে কাজ করেন। শৈশব কাল থেকে খান আতিয়ূর রহমান (রহঃ) ছিলেন সত্যবাদী, ক্ষমাশীল, ধৈর্যশীল ও কর্তব্যনিষ্ঠ। তার জীবনধারণ পদ্ধতি ছিল খুবই সাধারণ। এমনিভাবে চলতে থাকে খান আতিয়ূর রহমান (রহঃ) এর জীবন। যৌবনের এক পর্যায়ে এসে তিনি নলতা শরীফের সুলতানুল আউলিয়া, কুতুবুল আকতাব, আরেফ বিল্লাহ, গাউছে জামান হযরত শাহ সুফী খান বাহাদুর আহছান উল্যাহ (রহঃ) এর সান্নিধ্য লাভ করেন। এরপর থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি নলতা শরীফের খতিব পদে অধিষ্ঠ ছিলেন। খান আতিয়ূর রহমান (রহঃ) ছিলেন স্বাধীনতা কামী একজন মহান পুরুষ। তিনি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি রাত জেগে ইবাদত করতেন, আর দেশের স্বাধীনতা কামনা করে দোয়া চাইতেন। তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ, মুক্তিযদ্ধের নয় মাস তিনি রোজাব্রত পালন করেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে খান আতিয়ূর রহমান (রহঃ) প্রচুর ধন সম্পত্তির মালিক হন। কিন্তু এ ধন সম্পত্তি তিনি নিজের কাজে ব্যয় করেননি। তিনি জি-ফুলবাড়ি হাফিজিয়া মাদরাসা, আলিম মাদরাসা, পোস্ট অফিস, ব্যাংক, মসজিদ, আহছানিয়া মিশন, এতিমখানাসহ বহু প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। খান আতিয়ূর রহমান (রহঃ) এর জীবনের ব্রত ও শিক্ষা ছিল ¯্রষ্টার ইবাদত ও সৃষ্টের সেবা। তিনি বনের পশু পাখিকে খুব পছন্দ করতেন।
বনের পশুরাও তার অসাধারণ ব্যক্তিত্বকে অলৌকিকভাবে পছন্দ করতো। কথিত আছে, একবার একাধারে পাঁচ বছর তিনি ভারতে পেন্ডারোড হাসপাতালে কাটান। পেন্ডা রোডে থাকাকালিন বহু অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল তার মধ্যে স্মরনীয় ঘটনাটি ঘটে হলো, কোন এক রমজান মাসে। তিনি তারাবির নামাজের ইমামতি করার জন্য একদিন মসজিদে আসার সময় দুটি বাচ্চসহ একটি বাঘের সাথে দেখা হলে বাঘটি কোন হুংকার বা গর্জন না করেই পথ রোধ করে বসে থাকে। এ সময় অন্যান্য মুসুল্লিরা বিষয়টি দেখে খান আতিয়ূর রহমান (রহঃ) কে জানালো। তিনি এসে বাঘটিকে বাচ্চাসহ সরে যেতে বললেন। তিনি আরো বললেন, নামাজের সময় আর কখনো মুসুল্লিদের পথ রোধ করে থাকবে না। বাঘটি তৎক্ষনাৎ বাচ্চা দুটি নিয়ে নতশিরে চলে গেল। এই ঘটনার পর লোকে খান আতিয়ূর রহমান (রহঃ) কে পীর বলে আখ্যা দেয় এবং তাকে ইসলাম প্রচার ও প্রসারের কাজে সহযোগিতা করতে থাকে। খান আতিায়ূর রহমান (রহঃ) ছিলেন স্বল্পভাষী, অতিথিপরায়ন এবং মিতব্যয়ী ব্যক্তি। মেহমানদারী করা ছিল তার সবচেয়ে প্রিয় শখ। তিনি মিষ্টান্নদ্রব্য পছন্দ করতেন। ১৯৮৯ সালের ৫ফেব্রæয়ারি তিনি ইন্তেকাল করেন। তিনি সংসার জীবনে ৩ কন্যা ও ৬ পুত্র সন্তানের জনক ছিলেন। তার ওফাত উপলক্ষ্যে প্রতিবছর ইং ৪, ৫ ও ৬ ফেব্রæয়ারি বাংলা- ২২,২৩ ও ২৪ ই মাঘে দরগাহ শরীফে ওরছ অনুষ্ঠিত হয়। এ ওরছে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ভক্ত আশেকানরা ছুটে আসেন। খান আতিয়ূর রহমান (রহঃ) আজ আমাদের মাঝে নেই কিন্তু তার জীবনাদর্শ ও কীর্তি আমাদের মাঝে আজো স্মরনীয় ও বরণীয় হয়ে আছে।