অনলাইন ডেস্ক: গাইবান্ধার রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের পলাশবাড়ী ব্র্যাক মোড় সংলগ্ন বাঁশকাটায় গতকাল ভোরে যাত্রীবাহী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে উল্টে গিয়ে খাদে পড়ে। এতে বাসের ওপরের অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
আলম এন্টারপ্রাইজ। অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে ঢাকা থেকে নৈশ কোচটি যাত্রা শুরু করে শুক্রবার সন্ধ্যায়।
গন্তব্য ছিল ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল। তন্দ্রাচ্ছন্ন চালক গাড়ি চালাচ্ছিল এলোমেলো। চালককে সাবধান হতে প্রতিবাদীও হয়ে উঠেছিল যাত্রীরা। কিন্তু কে জানত, শনিবার ভোরের আলো ফোটার আগেই গাইবান্ধার পলাশবাড়ীই হবে সেই সব যাত্রীর ‘মৃত্যুবাড়ি’। রংপুর-বগুড়া মহাসড়কের পলাশবাড়ীর মহেশপুরসংলগ্ন বাঁশকাটা গরুরহাট এলাকায় নৈশ কোচটি পৌঁছতেই নিয়ন্ত্রণ হারায় চালক। গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে দ্রুতগতির বাসটি উল্টে গিয়ে পড়ে রাস্তার পাশের খাদে। এ সময় সড়কে মৃত্যুর মিছিলে একে একে যোগ দেয় হতভাগ্য ১৮ যাত্রী। আহত হয় কমপক্ষে ২৫ জন। এ তো গেল পলাশবাড়ী।
রংপুরের দুর্ঘটনাটি আরো মর্মস্পর্শী। সেখানে চালক দিব্যি ঘুমাচ্ছিল। ট্রাক চালাচ্ছিল হেলপার। শনিবার ভোর, পাগলাপীর সলেয়াশাহ এলাকায় রাস্তার পাশেই পাল্টানো হচ্ছিল একটি বাসের চাকা। ওই বাসের যাত্রীরা সে সময় সড়কে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। তখন বালুবোঝাই সেই ট্রাক দ্রুতগতিতে এসে রাস্তায় বসে থাকা ছয় যাত্রীর প্রাণপ্রদীপ কেড়ে নেয়। ‘সড়ক সন্ত্রাস’ এখানেই শেষ নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে গত ২৪ ঘণ্টায় সড়ক থামিয়ে দিয়েছে আরো ১৪ জনের জীবন। আহতের খাতায় নাম লিখিয়েছে শতাধিক ব্যক্তি। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠনো খবরে বিস্তারিত :
গাইবান্ধা : রংপুর-বগুড়া মহাসড়কের পলাশবাড়ী সদরের মহেশপুরসংলগ্ন বাঁশকাটা গরুরহাট এলাকায় গতকাল শনিবার ভোরে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৮ যাত্রী নিহত ও কমপক্ষে ২৫ জন আহত হয়। আহতদের পলাশবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। খবর পেয়ে স্থানীয় পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধারকাজ চালায়। নিহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ধারণা করছে।
নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৬ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলো রংপুরের গঙ্গাচড়ার এমদাদ আলী, গাইবান্ধার সাদুল্যাপুরের ইউনুস আলী, নীলফামারীর জলঢাকা মিনারুল খান, কুড়িগ্রামের চর রাজীবপুরের মাসুদ রানা, কুষ্টিয়ার মিরপুরের আব্দুর রশিদ, দিনাজপুরের বীরগঞ্জের আখতারুল ইসলাম, টাঙ্গাইল সদরের রুবেল হোসেন ও শাহজাহান সিকদার, ঠাকুরগাঁও সদরের আব্দুর রহিম, এনামুল হক ও মকবুল হোসেন; বালিয়াডাঙ্গীর শফিকুল ইসলাম, হরিপুরের ইসমাইল হোসেন, রুবেল মিয়া ও বিশ্বনাথ চন্দ্র রায় এবং পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার জহিরুল ইসলাম। তারা পেশায় গরু ব্যবসায়ী ও শ্রমিক।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ঢাকা থেকে আলম এন্টারপ্রাইজ (ঢাকা মেট্রো ব-১৪-৬৪২২) নামের নৈশ কোচটি গত শুক্রবার সন্ধ্যায় অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈলে যাচ্ছিল। পথে গতকাল ভোর সোয়া ৪টার দিকে পলাশবাড়ী সদরের উত্তর পাশে ব্র্যাক মোড়সংলগ্ন বাঁশকাটা গরুরহাট এলাকায় এসে নৈশ কোচটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশের একটি গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে উল্টে খাদে পড়ে। এ সময় নৈশ কোচটির ছাদসহ গোটা গাড়িটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। আহত যাত্রী বাদশা মিয়া অভিযোগ করেন, ঈদের পর অনেকেই বাড়ি ফিরছিল। তাই বাসটিতে অতিরিক্ত যাত্রী ছিল। ঘটনার আগে চালক কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় ছিল। এলোমেলো গাড়ি চালাতে দেখে তাকে সাবধান করার পরও সে সতর্ক হয়নি।
মহেশপুর এলাকার স্থানীয় কৃষক শামসু মিয়া বলেন, প্রচণ্ড শব্দে ভোরে তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। তিনি এসে দেখেন বাসটির চাকা ওপরদিকে তখনো ঘুরছে। ভেতরে আহত যাত্রীরা তাদের প্রাণ রক্ষার আকুতি জানাচ্ছে। তখন গ্রামবাসীর সহায়তায় শিশু, নারীসহ অন্য যাত্রীদের বের করা হয়। তাদের রিকশা ভ্যান, অন্য গাড়িতে করে পলাশবাড়ী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠানো হয়। পরে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজন এসে উদ্ধার কাজ শুরু করে। ফায়ার সার্ভিসের সহকারী উপপরিচালক আমিনুল ইসলাম জানান, প্রচণ্ড গতির কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাসটি গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে উল্টে যায়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট উদ্ধার তৎপরতা চালায়।
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক গৌতম চন্দ্র পাল, পুলিশ সুপার প্রকৌশলী আব্দুল মান্নান মিয়া, হাইওয়ে পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান, ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আরিফ হোসেন, থানা অফিসার ইনচার্জ মাহমুদুল আলম, উপজেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা (পিআইও) শাহীনুর আলমসহ অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধার তৎপরতায় সম্পৃক্ত হন। এ সময় জেলা প্রশাসক গৌতম চন্দ্র পাল নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দেন।
রংপুর : রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কের রংপুরের পাগলাপীরের সলেয়াশাহ বাজার এলাকায় শুক্রবার গভীর রাতে বাস-ট্রাক সংঘর্ষে ছয়জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে কমপক্ষে ১০ জন। দুর্ঘটনার সময় চালক ঘুমিয়ে ছিল এবং হেলপার ট্রাকটি চালাচ্ছিল বলে জানান তারাগঞ্জ থানার ওসি জিন্নাত আলী। পুলিশ জানায়, পাগলাপীর সলেয়াশাহ এলাকায় গতকাল ভোরে দিনাজপুর থেকে ঢাকাগামী বিআরটিসির দ্বিতল একটি বাসের চাকা পাল্টানো হচ্ছিল। বাসের যাত্রীরা এ সময় সড়কে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। তখন পেছন থেকে বালুবোঝাই একটি ট্রাক এসে সড়কের ওপর বসে থাকা যাত্রীদের চাপা দিয়ে বাসের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। এতে ঘটনাস্থলেই দুই নারীসহ ছয়জনের মৃত্যু হয়। আশঙ্কাজনক অবস্থায় ১০ জনকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নিহতদের শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়ায় কাউকেই চেনা যাচ্ছে না বলে চিকিৎসক ও স্বজনরা জানিয়েছে। এদের মধ্যে নিশাত (২০) ও সাজ্জাদ (১৯) নামের দুজনকে শনাক্ত করেছে তার স্বজনরা। তাদের বাড়ি দিনাজপুরে। বাসটিতে শতাধিক যাত্রীর বেশির ভাগই ছিল ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফেরা গার্মেন্টকর্মী। ট্রাকটি জব্দ করা গেলেও চালক ও হেলপার পালিয়ে গেছে। তারাগঞ্জ হাইওয়ে পুলিশের কর্মকর্তা সাইফুল জানান, বালুবোঝাই ট্রাকটি চালাচ্ছিল ট্রাকের হেলপার আর ড্রাইভার ট্রাকের মধ্যে ঘুমিয়ে ছিল। হেলপার দ্রুতবেগে গাড়ি চালানোর কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এ সময় এটি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ওপর উঠে যায় এবং দ্বিতল বাসটিকে ধাক্কা দেয়।
ফরিদপুর : ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের ফরিদপুরের ভাঙ্গার পূর্ব সদরদী এলাকায় গতকাল সকালে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তুহিন পরিবহনের একটি বাস খাদে পড়ে গেলে দুজন নিহত ও ১৫ জন আহত হয়েছে। নিহত ব্যক্তিরা হলেন বাসচালক ইব্রাহীম প্রামাণিক (৪০) ও হেলপার হাবিব (২৬)।
গোপালগঞ্জ : গোপালগঞ্জে আলাদা দুটি সড়ক দুর্ঘটনায় তিনজন নিহত ও ২৫ জন আহত হয়েছে। গতকাল সকালে গোপালগঞ্জ-টুঙ্গিপাড়া সড়কের ঘোনাপাড়া মোড় এবং দুপুরে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের মুকসুদপুর উপজেলার দাসের হাট নামক স্থানে এ দুটি দুর্ঘটনা ঘটে। ঘোনাপাড়ার দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিরা হলেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘রিক’-এর গোপালগঞ্জ অফিসের মাঠকর্মী পুলক ব্যাপারী (২৮) ও ইমরান হোসেন (৩০)। এ ঘটনায় পথচারীসহ কমপক্ষে ১৫ জন আহত হয়। মুকসুদপুরে বাসচাপায় নিহত হন ভ্যানচালক লোকমান শেখ (৫০)। তিনি একই উপজেলার হাতিমপুর গ্রামের ইসমাইল শেখের ছেলে। এ ঘটনায় আহত হয়েছে ১০ বাসযাত্রী।
লক্ষ্মীপুর : রামগতিতে মালবাহী পিকআপ ভ্যান ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে দুজন নিহত ও চারজন আহত হয়েছে। গত শুক্রবার রাতে রামগতি-সোনাপুর সড়কের শেখের কিল্লা এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত দুজন হলেন রামগতির চরআফজল গ্রামের গোফরান মিয়ার ছেলে মো. মিলন (৫০) এবং একই এলাকার শাকেরা খাতুন (৭০)।
সিরাজগঞ্জ : ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কে সলঙ্গার কালিকাপুর এলাকায় গতকাল ভোরে বাস-ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে চালক ও হেলপার নিহত হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছে আরো ১৫ যাত্রী। নিহত ব্যক্তিরা হলো রায়গঞ্জের শ্যামনাই গ্রামের জসিম উদ্দিনের ছেলে ট্রাকচালক শরিফ উদ্দিন এবং দুখা শেখের ছেলে হেলপার শফিকুল ইসলাম।
চুয়াডাঙ্গা : চুয়াডাঙ্গার আলোকদিয়া গ্রামে শুক্রবার রাতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পথচারী ওবায়দুর রহমান (৫০) নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় মোটরসাইকেলের দুই আরোহী আহত হয়েছে।
সাভার (ঢাকা) : ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে সাভারের তুরাগ এলাকায় গতকাল সকালে বাস-ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে একজন নিহত ও ২০ জন হয়েছে। নিহতদের নাম ও পরিচয় জানা যায়নি।
গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) : গোয়ালন্দের দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় গতকাল দুপুরে গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে বাসচালকের সহকারী ইমন সরদার (২০) নিহত হয়েছেন। ইমন ফরিদপুরের নগরকান্দার বড়াইগ্রামের মো. ইসমাইল সরদারের ছেলে।
রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) : রূপগঞ্জের পোনাব এলাকায় গতকাল সকালে ট্রাকের ধাক্কায় একটি কার্গো খাদে পড়ে একজন নিহত ও চারজন আহত হয়েছে। নিহত ব্যক্তির নাম ও পরিচয় জানা যায়নি।
সখীপুর (টাঙ্গাইল) : সখীপুর-গোপিনপুর সড়কের তৈলধারা বাটার মোড় এলাকায় গতকাল শনিবার সকালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আবদুল বাছেদ মিয়া (৩০) নামের এক যুবক নিহত হয়েছেন। বাছেদ উপজেলার জিতাশ্বরী গ্রামের আবদুল জব্বার মিয়ার ছেলে।
হাওরাঞ্চল : নেত্রকোনার দুর্গাপুরে যাত্রীবাহী মাহেন্দ্র ও মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে শাওন মিয়া (১৩) নামের এক কিশোর নিহত হয়েছে। এ দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে আরো ৯ জন। এর মধ্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় তিনজনকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।