গাজী আবদুর রহিম: আমার কাছে স্বাধীনতা মানে পাকিস্তানি শোষক মহলের কব্জা থেকে ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে জন্ম নেওয়া লাল- সবুজের বাংলাদেশ। আমার কাছে স্বাধীনতা মানে বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারা, ভোরে ধানের মাঠে দোয়েলের শিস শুনে মুগ্ধ হওয়া, ইচ্ছে হলে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ইচ্ছে মত সাঁতার কাটা, দিগন্ত বিস্তৃত প্রকৃতি দেখে নিজের দুঃখকে বাতাসে উড়িয়ে দেওয়া। আমার কাছে স্বাধীনতা মানে মনে সমস্ত ভালো লাগাতে মনের মাধুরি মিশিয়ে বাংলা বর্ণমালা দিয়ে সাহিত্যচর্চা করতে পারা। স্বাধীনতা সেত হাজারো দেশত্ববোধক গান, কবিতা, গল্প।
আমি বাঙালী। আমাদের জাতীয়তা বাংলাদেশী।বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যে দেশ সাত সাগর রক্ত আর তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমে কেনা। আমি গর্বিত রাষ্ট্রের নাগরিক। আমার সবচেয়ে বড় গর্ব ‘আমি স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক‘। প্রতিদিন যখন বিটিভিতে সংবাদের আগে জাতীয় সংগীতের তালে তালে জাতীয় পতাকা ওড়ে, আমার মনে অন্য রকম একটা শিহরণ জাগে। আমার কাছে এই শিহরণটাই স্বাধীনতা। শুধু আমার কাছে না এদেশের প্রতিটি নাগরিকের কাছে স্বাধীনতা মানে লাখো শহিদের রক্তে গড়া বিশ্ব মানচিত্রে জীবন্ত লাল-সবুজের মানচিত্র। আর এই মানচিত্র একটি স্বাধীন দেশের প্রতীক।
এদেশের মানুষের কাছে স্বাধীনতা শব্দটি খুব কষ্টের আবার অনাবিল সুখের। কারণ আমাদের দেশ এক সময় পাকিস্তানি শোষক মহলের কব্জায় বন্দি ছিল। তৎকালিন শোষক গোষ্ঠী এদেশের মানুষের সমস্ত অধিকার হরণ করেছিল। তারা এদেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল ঊর্দু ভাষা। এদেশের প্রতিবাদী জনতা শেষ শোষনে রক্ত দিয়ে প্রতিবাদের মাধ্যমে তার ভাষাকে নিজের করে নিয়েছিল। আর দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অর্জন করেছিল।
আমরা স্বাধীনতার স্পষ্ট চিত্র দেখতে পাই কবি শামসুর রাহমানের কবিতায়-
‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খা-বদাহন?’
এই কবিতা পাঠ করে ১৯৭১ সালে এদেশের মানুষের মনে স্বাধীনতার যে তীব্র আকাঙ্খা ছিল সেটা প্রকাশ পেয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা এতটা নাটকীয় যে ইতিহাস পাঠ করলে দেখতে পাবেন আমাদের স্বাধীনতা হাজারো নৃশংস গল্প, সিনেমার কাহিনীকেও হার মানায়।
আমার কাছে স্বাধীনতা শব্দের সর্বউৎকৃষ্ট উদাহরণ স্বাধীন বাংলাদেশ।
স্বাধীনতা সেত ৭ই মার্চে রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবের ভাষণ। তবে আরো একটা কথা আছে। স্বাধীনতা মানে শুধু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নয়।এর বাইরে আরো অগণিত স্বাধীনতা আছে। আমার কাছে স্বাধীনতা মানে দখলবাজ, ভূমিদস্যুদের কবল থেকে বঞ্চিত মানুষের সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়া। আমাদের স্বাধীনতার এই পঞ্চাশ বছর পরেও মানুষ এখনো স্বাধীনতা শব্দটার খুব প্রয়োজন অনুভব করছে। এখনো দেশের প্রায় প্রতিটি প্রান্তে সন্ত্রাসী, মাফিয়া, ভূমিদস্যু, রাঘব বোয়ালদের দাপট চলে। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলে মানুষ খুন, গুম হচ্ছে। এখনো দেশে নদী, খাল, খাস জমি দাপটশালী নেতারা জোর করে খাচ্ছে এমন চিত্র প্রতিনিয়ত দৈনিক সংবাদপত্র গুলোয় চোখ বোলালে দেখতে পাবেন।আর এই সব নদী, খাল, খাস জমি বেদখল হওযার ফলে দরিদ্র কৃষকরা অসহায় দিন যাপন করছে।এখনো আমাদের উচিত এই সব দখলবাজ, রাঘব বোয়াল নেতাদের মুখোস উন্মোচন করে অসহায় মানুষের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়া।
আমার কাছে স্বাধীনতা মানে নারী অধিকার ফিরে পাওয়া। এখনো দেশের অনেক নারী পরাধীনতার ভেতরে আটকে আছে। তারা না পারে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে, না পারে জীবিকাস্থলে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে। আমাদের দেশে বহু নারী ক্ষমতাবাজদের কাছে জিম্মি হয়ে বেঁচে আছে।কেবল আমাদের দেশেই দেখি নুসরাত জাহান রাফির মত মেয়েকে আগুনে দগ্ধিত হতে, তণুর মত মেয়ে ধর্ষিত হতে, খাদিজার মত মেয়েকে ধর্ষণের পরে খুন হতে। আমার কাছে স্বাধীনতা মানে নারীর সমস্ত অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া।
কথায় আছে, ‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা আরো কঠিন‘। আমার কাছে স্বাধীনতা মানে যদি কোন অপশক্তি এসে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে হরণ করতে চেষ্ট করে তাহলে বুকের শেষ রক্ত দিয়ে হলেও দেশকে রক্ষা করতে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাওয়া।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট