নিয়ামুর রশিদ শিহাব : কালের বিবর্তন ও প্রযুক্তির বিকাশে যে সকল পেশা এখন বিলুপ্ত তার মধ্যে অন্যতম করাতি পেশা। করাতকলে যান্ত্রিকতার ছোয়া লাগায় এ পেশার কদর দিন দিন কমে গেছে। এ কারনেই জীবন-জীবিকার তাগিদে সবাই পেশা বদল করেছেন।
আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বিশ্ব এগিয়ে চলেছে। প্রগতি ও প্রযুক্তির যুগে কর্মব্যস্ত মানুষের ব্যস্ততা যেমন বেড়েছে, তেমনি যে কোনো কাজ কম খরচে দ্রুত সম্পন্ন করতে পারলেই মানুষ হাফ ছেড়ে বাঁচে বলে ধারণা জন্মেছে। তাই গ্রাম-গঞ্জেও এখন পুরোপুরি করাতকলের যান্ত্রিকতার ঢেউ লেগেছে। কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে করাতের ছন্দময় শব্দ। বিভিন্ন হাট-বাজারের অগণিত করাতকল অতি কম খরচে অল্প সময়ের মধ্যে চাহিদা মাফিক কাঠ চিরানো হচ্ছে। সেই সাথে আসবাবপত্রের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় যান্ত্রিক করাতকলের কদর বেড়েছে। তাই করাতিদের গাছ কাটতে আগের মতো তেমন দেখাই যায় না ।
এক সময় পটুয়াখালী জেলার প্রায় গ্রামেই করাতি স¤প্রদায়ের লোকজন বসবাস করতো। তারা প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুম এলেই জেলার বিভিন্ন গ্রামে দল বেঁধে ঘুরত এবং পাড়ায় পাড়ায় ফেরি করে গাছ কাটার কাজ নিত। তৎকালীন সময়ে গৃহস্থালীরাও গাছ কাটতে হলে করাতিদের অপেক্ষায় থাকতে হতো।
গ্রামের বয়বৃদ্ধদের কাছ থেকে জানা যায়, তখনকার সময়ে করাতিরা মাটিতে গর্ত করে বা কয়েকটি গাছের সাথে কাঠের কাঠামো তৈরি করে করাত চালিয়ে গাছ কাটতেন। এই ধরনের করাত চালাতে উপরে এক জন আর নিচে অন্তত দুই বা ততোধিক মানুষের প্রয়োজন হতো। হাতলযুক্ত করাত দিয়ে উপর-নিচ টেনে একটি গাছ থেকে বিভিন্ন সাইজের কাঠ চিরানো হতো। তৈরিকৃত খুটি আর তক্তা দিয়ে ঘরের ছাউনি ও নানা রকম আসবাবপত্র তৈরি করা হতো। সে সময় কাঠ চিরতে আকার ও প্রকার ভেদে বর্গফুট হিসেবে মজুরি নিতেন করাতিরা।
একটি মাঝারি সাইজের গাছ কাটা ও চিরানোতে এক দেড় হাজার টাকা খরচ পড়তো। আর তাতে সময় লাগতো প্রায় তিন দিনেরও বেশি। করাতিরা সকাল সকাল গুড়-পান্তা খেয়ে কাজে নেমে পড়তেন। করাতিদের অনেক পরিশ্রম হতো তাই তারা অত্যাধিক পরিমান খাবার খেতে পারত। লোক মুখে প্রচলিত আছে, পরিশ্রমের পর খাবারের সময় একজন করাতি এক সেরের চালের ভাত খেতে পারত। এভাবে পুরো মৌসুম কাটিয়ে দিতেন তারা।
নব্বই দশকের আগেও করাতিদের গাছ কাটার এমন দৃশ্য দেখতে পাড়ার ছেলেরা ভিড় করতো। কখনও কখনও গাছ কাটার সময় থাকতো নানান সুরের গান। গানের তালে তালে চলত গাছ কাটা। আর চারপাশে ভিড় জমাতো ছেলে-বুড়োরা। মুগ্ধ হয়ে এই দৃশ্য উপভোগ করতেন সবাই।
এ বিষয়ে গলাচিপা মহিলা ডিগ্রি কলেজের সমাজবিজ্ঞানের প্রভাষক ও নয়াদিগন্ত পত্রিকার উপজেলা প্রতিনিধি মোঃ হারুন অর রশিদ জানান, তিন দশক আগেও মৌসুম ভেদে গ্রামীন সমাজের পথে প্রান্তরে করাতি সম্প্রদায় দেখা গেলেও করাতকলে আধুনিকতার ছোয়া লাগায় এখন করাতি পেশাই বিলুপ্ত। তাই এই সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য ও স্মৃতি সমূহ সংরক্ষন করা না হলে ভবিষ্যতে অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।
শিক্ষার্থী, বরিশাল পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউট